যানজট ও পরিবহন সংকটে নগরীতে পথ চলাই দায়। গাড়ি না পাওয়ায় বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় যাত্রীদের। নারী যাত্রীদের তো সংগ্রামের শেষ নেই। পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। এর সঙ্গে রয়েছে পথেঘাটে নিরাপত্তাহীনতা। সকাল থেকে শুরু করে রাতে বাসায় ফেরা পর্যন্ত পদে পদে নিগ্রহের শিকার হতে হয় কর্মজীবী নারীদের। শিক্ষার্থীদেরও একই অবস্থা। বৃহস্পতিবার কাওরান বাজার আন্ডারপাসের সামনে গাড়ির জন্য প্রায় ১ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলেন নূরজাহান বেগম। যে বাসেই উঠতে যান হেলপার বলেন, ‘মহিলা সিট খালি নাই, উঠোন যাইবো না।’ পুরুষ যাত্রীরা বাদুড়ঝোলা হয়ে উঠলেও সেটা পারেন না তিনি। সিটিং সার্ভিসেও সিট খালি না থাকায় জায়গা হয় না। জানতে চাইলে আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বলেন, বাসা খিলগাঁওয়ে। অফিস পান্থপথে। তাই প্রতিদিন সকাল বিকাল আসা যাওয়া করতে হয়। অফিস শেষে প্রায় প্রতিদিনই অন্তত দেড়ঘণ্টা চেষ্টার পর কোনো গাড়িতে উঠতে পারি। অফিসে আসার সময়ও এমন কষ্ট করে আসতে হয়। এতদূরে হেঁটেও যাওয়া যায় না। তিনি বলেন, কখনো কখনো ভিড় ঠেলে গাড়িতে উঠতে পারলেও নিজেদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলো থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক সময় মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে পুরুষরা বসে থাকে। উঠতে বললে জড়াতে হয় বিতণ্ডায়। কখনো কটুকথার পাশাপাশি বাঁকাদৃষ্টিতে বিদ্ধ হতে হয়। মায়মুনা খাতুন তিতুমীর কলেজের ছাত্রী। বলেন, কলেজে যাওয়া আসার সময় প্রায় প্রতিদিনই লোকাল বাসে চলাচল করতে হয়। অনেক সময় ভিড়ের কারণে বসা তো দূরের কথা, দাঁড়ানোর জায়গাও পাওয়া যায় না। ভিড়ের মধ্যে বাসে উঠলে অনেক সময় যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। পড়ালেখা বা চাকরির প্রয়োজনে আমার মতো হাজার হাজার নারীর নিয়মিত লোকাল বাসে চড়তে হয়। কিন্তু বাসে সংরক্ষিত সিট থাকে সর্বোচ্চ ৯টি। এজন্য প্রতিনিয়তই নারীদের এমন বাজে অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয়। জান্নাতুল নাঈমা নামের অপর এক ছাত্রী বলেন, লোকাল বাসগুলোর ইঞ্জিন কভারের কাছে মেয়েদের জন্য কিছু মহিলা আসন সংরক্ষিত থাকে। ইঞ্জিনের উত্তাপের ওপর সীমাহীন সহ্যক্ষমতা নিয়ে বসে থাকতে হয়। তারচেয়ে অসহ্য বিষয় হলো, ইঞ্জিনের মেয়েদের সিটের ঠিক উপরেই থাকে হোল্ডার, যেটা আঁকড়ে ধরেই অনেক পুরুষ যাত্রী মেয়েদের মুখের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে থাকেন। সিটি কলেজের ছাত্রী সুমা আফরোজ বলেন, তার বাসা আরামবাগে। ক্লাস শুরু হয় সকালে। বাস পেতে দেরি ও রাস্তায় যানজট থাকায় খুব সকালে বাসা থেকে বের হতে হয়। বাসের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। পথে নেই কোনো যাত্রী ছাউনি, যেখানে বসে অপেক্ষা করা যায়। আরেক ছাত্রী শামীমা রহমান বলেন, বাসে ওঠানামা নিয়ে হয়রানি হতে হয়। বাসের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। পুরুষদের কটূক্তির শিকার হতে হয় পদে পদে। বাসে ভিড় বেশি হলে তো উঠতেই পারি না। নাঈমা সিদ্দিকা নামের অপর এক ছাত্রী বলেন, প্রায়ই ভিড়ের মধ্যে বাসে নারীদের জন্য নির্ধারিত আসনগুলোতে পুরুষরা বসে থাকে। উঠতে বললে জবাব আসে, সিট নেই দেখেই তো বাসে উঠেছেন। এখন বসতে চাইছেন কেন। উঠতে চায় না, বরং আরো কয়েকজন মিলে গলা মিলিয়ে বলে, পাবলিক বাসে সমস্যা হলে প্রাইভেট গাড়িতে যাওয়া-আসা করবেন। আবার সাধারণ আসনে বসলে অনেকে বলেন, এখানে বসেছেন কেন। মহিলা আসনে গিয়ে বসেন। সরকারি কর্মজীবী মাহফুজা বেগম বলেন, কখনো বাসে উঠা নিয়ে, কখনো বাসে সিট পাওয়া নিয়ে, কখনোবা সিট পাওয়ার পর নিশ্চিন্তে গন্তব্যে পৌঁছা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। অধিকাংশ সময় বাসে সিট না থাকায় মহিলাদের উঠাতে চায় না। গাড়ি না পেয়ে ভরা বাসে উঠতে চাইলে বলে মহিলা সিট নেই। উঠানো যাবে না। শুধু সিট না থাকার কারণে মেয়েদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। দেখা যায় মেয়েদের জন্য বরাদ্দ সিটগুলো পুরুষরা আগে থেকেই দখলে রেখেছে। অনেক সময় দেখা যায় বাসের হেল্পার যখন পুরুষদের মহিলা সিট ছেড়ে দিয়ে মহিলাদের জায়গা দিতে বলে, তখন ওই পুরুষরাই হেল্পারকে আক্রমণ করতে তেড়ে আসে। বেসরকারি চাকরিজীবী খুরশিদা বেগম প্রশ্ন রেখে বলেন, আপনারা মেয়েদের বসার জায়গা দেবেন না, দাঁড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ দেবেন না, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা আপনাদের চলে যাওয়া দেখবে, তাহলে মেয়েরা গন্তব্যে পৌঁছাবে কীভাবে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, গণপরিবহনের সংরক্ষিত আসন পেতে নারীর বিড়ম্বনার জন্য সরকারের উদাসীনতা দায়ী। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিষয়টি এখনো কেবল মৌখিক ঘোষণার মধ্যে রয়ে গেছে। কাগজপত্রে কিছু নেই, সবকিছু মুখে মুখে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য বিষয়টির সুরাহা দরকার। তিনি বলেন, পরিবহনে নারীদের জন্য সুযোগ-সুবিধাও বাড়ানো দরকার। তাদের যাতায়াত ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন করতে না পারলে অনেকে যাত্রাপথে হেনস্থার শিকার হয়ে কর্মক্ষেত্রের প্রতি আগ্রহ হারাবেন। বিআরটিএ পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) নাজমুল আহসান মজুমদার বলেন, নগরের বাসগুলোতে নারীদের জন্য আসন নির্ধারিত আছে কিনা বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত তদারকি করে। গরমিল পেলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়।