
উচ্চ মাধ্যমিকে এবার পাশ করেছে প্রায় ১৩ লাখ ৭ হাজার শিক্ষার্থী। অন্যদিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন আছে ১৪ লাখ ১৮ হাজার। তবে এরপরও এ স্তরে ৫ লাখের বেশি আসন খালি থাকবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এইচএসসি পাশের পর অন্তত ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। এছাড়া একটি অংশ বিদেশে লেখাপড়া করতে যান। অনেকেই নার্সিংসহ বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষায় ভিড়ে যান। ফলে সবমিলে আসনে নয়, সংকট দেখা দেবে পছন্দের বিভাগ আর প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে। এটা চিরাচরিত দৃশ্য বলেই মনে করেন তারা।
এদিকে এবার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন সংকট দেখা দিতে পারে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে। তিনটি মাত্র বিষয়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হয়েছে এইচএসসি ও আলিম পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাধারণত শিক্ষার্থীদের পাণ্ডিত্য(!) যাচাই করতে গোটা বই থেকে কঠিন প্রশ্ন করে থাকে। ফলে পছন্দের প্রতিষ্ঠানে আসন সংকটের পাশাপাশি প্রশ্নপত্রের সংকটেও পড়তে পারে তারা।
রোববার সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষা যে সিলেবাসে হয়েছে, ঠিক সেই সিলেবাসের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাগুলো হওয়া যৌক্তিক ও সঠিক। যে সিলেবাসে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসেছে, সে অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষা না হলে তাদের প্রতি সুবিচার করা হবে না। এর বাইরে অন্য কিছু কেউ করবেন বলে মনে করি না। যদি কেউ করতে চান, তাদের অনুরোধ করব। ইতোমধ্যে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে বলে জানান। এছাড়া গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটিতে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি। শিক্ষামন্ত্রী এ সময় আসন সংখ্যা এবং গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়েও কথা বলেন। তিনি জানান, ভর্তিতে আসন সংকট হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কর্মকর্তারা জানান, গতবছর শতভাগ শিক্ষার্থী এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাশ করেছিল। সংখ্যার বিচারে তা এবারের চেয়েও বেশি ছিল, ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত আসন খালি আছে। বিশেষ করে প্রথমবারের মতো গুচ্ছভুক্ত ২০ বিশ্ববিদ্যালয় এখনও ভর্তি শেষ করতে পারেনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়েও আসন খালি আছে।
২০১৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাশ করেছিল ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ শিক্ষার্থী। ওই বছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও স্নাতক কলেজসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিল ৭ লাখ ৮২ হাজার ৬১৬ জন। এদের মধ্যে অন্তত ১ লাখ শিক্ষার্থী আগের বছর এইচএসসি পাশ করা। অন্যদিকে ২০১৯ সালে বিভিন্ন ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন ছিল ৯ লাখ ২৬ হাজার ৬১টি। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যার চেয়েও ১ হাজার ৪১৩ জন বেশি ভর্তি করা হয়েছিল। এরপরও ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৫৪টি আসন খালি ছিল।
২০২০ সালে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আসন ছিল ১৪ লাখ ১৭ হাজার ৭০৬টি। ভর্তি হয়েছে ১১ লাখ ৮১ হাজার ১৯৮ জন। আসন খালি ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫০৮টি। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যার অতিরিক্ত ৭৩৬ জন ভর্তি করার পরও এ শূন্যতা ছিল।
বিগত বছরগুলোর ভর্তির প্রবণতা থেকে ইউজিসি বলছে, যদি ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীও ভর্তি হয় তাহলে ৯ লাখ ১৫ হাজারের মতো আসন লাগবে। যেহেতু উচ্চশিক্ষা স্তরের প্রতিষ্ঠানে আসন আছে ১৪ লাখ ১৮ হাজার, তাই ভর্তিতে সংকট দূরের কথা, ৫ লাখের মতো আসন শূন্যই থাকবে।
এ প্রসঙ্গে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর রোববার রাতে যুগান্তরকে বলেন, চলতি বছর উচ্চশিক্ষায় ভর্তিতে আসনের ক্ষেত্রে কোনো সংকট হবে না। প্রথমত, সব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় আসে না। গত বছরও আগের পাশ করা এবং নতুন পাশ করা মিলিয়ে মোট আসনের ৮৩ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। সেটা পৌনে ১২ লাখের মতো। আবার এদের মধ্যে আগের বছর পাশ করা অনেকে আছে। যেটা ৪ শতাংশের কম হবে না। দ্বিতীয়ত, নিয়মিতদের মধ্যে ঝরে যাওয়ার পর যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি হবে, তাদের প্রায় সবাই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে। আর পাশ করা সবাই যদি ভর্তি হতে চায়, তবুও সংকট হবে না। কেননা, পাশ করা শিক্ষার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশে পড়তে যায়।
তিনি বলেন, তবে এটা ঠিক, সংকট হবে পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও বিষয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে। বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেলসহ হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠানে তীব্র প্রতিযোগিতা হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য যার টাকা আছে, তার কোনো সংকট নেই। পাবলিক প্রতিষ্ঠানে চান্স না পেলে এসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বা মেডিকেলে ভর্তি হয়ে যাবে। সুতরাং, পছন্দের প্রতিষ্ঠান ও বিষয়ে ভর্তির এ সংকট থাকবে, যেটা সর্বত্র আছে। উন্নত বিশ্বেও কিছু প্রতিষ্ঠানে অনেক আবেদন পড়ে। আবার কিছু অনেক সুযোগ দিয়ে ডেকে নেয়। তাই ভর্তির সংকট সারা বিশ্বেরই চিত্র। এটা সমাধানযোগ্য নয়, কখনোই সমাধান হবেও না।
ইউজিসির তথ্য অনুসারে, উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ হাজার আসন আছে। এছাড়া ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লাখ ৩ হাজার ৬৭৫, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজে ডিগ্রি পাশ ও স্নাতকে ১০ লাখ ৯৩ লাখ ৮১১, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ফাজিল ও অনার্স মাদ্রাসায় ৬০ হাজার আসন আছে প্রথমবর্ষে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা নির্ধারিত নেই। তবে সর্বশেষ ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় গত বছর। দুটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৪০, সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ১০ হাজার ৪০৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজে ২৩ হাজার ৩৩০ আসন আছে। ৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ৭২০, ছয়টি টেক্সটাইল কলেজে ৭২০, সরকারি ও বেসরকারি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি প্রতিষ্ঠানে ৫ হাজার ৬শ, ১৪টি মেরিন অ্যান্ড অ্যারোনটিকাল কলেজে ৬৫৪, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাড়ে ৩ হাজার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ২৯০টি আসন আছে।
ইউজিসি সদস্য ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে দেশের ২০টি সাধারণ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৬টি কৃষি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারও ওইসব প্রতিষ্ঠানই গুচ্ছ পদ্ধতিতে আসছে। এখন পর্যন্ত গুচ্ছের আওতা বাড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত সর্বনিম্ন সাড়ে ৩ জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীরা আবেদনের সুযোগ পায়। আর কলেজগুলোতে জিপিএ-২ পেলেও আবেদন করা যায়। তবে ভালো ফল ছাড়া ভর্তির সুযোগ কম। সেই হিসাবে এইচএসসি-আলিম পাশ করা সবাই উচ্চশিক্ষায় যাবে না।
ভর্তির সংকট সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পাশ করাদের মধ্যে কেউ উচ্চশিক্ষায় যাবেন। কেউ এখনই কাজে চলে যাবেন। কেউ কারিগরি শিক্ষায় যাবেন। আমাদের একেবারেই মনে হয় না, আসন সংকট হবে। তিনি বলেন, যে সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আছে, সেখানে এবং যে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে এবং অন্যান্য যে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেগুলোতে সবমিলিয়ে অনেক কলেজ আছে দেশে। সবমিলে প্রায় আড়াই হাজার বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি দেওয়া হয়। আমরা প্রতিবছরই দেখি-অনেক আসন আসলে খালি থেকে যায়।
দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ : এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে দ্বিতীয়বার শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ দেওয়া উচিত। যদি একেবারে বৈশ্বিক পরিস্থিতি, বিশ্বমানের কথা চিন্তা করি, তাহলে আসলে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিক করেছে একবারের বেশি না। আগে দুবার দেওয়া হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার পরীক্ষা দেওয়ার পর আরও সুযোগ ছিল। এখন সেই সুযোগ রাখা হচ্ছে না। এটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তারা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান।
এ নিয়ে ইউজিসিসহ তার কথা হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীদের জন্য এ সুযোগ যদি বাড়াই, তাতে তো অসুবিধা নেই। আপনি যে মেধার শিক্ষার্থী নেবেন, আপনি তো সেই মেধার শিক্ষার্থীই নিচ্ছেন। আপনি তো তার থেকে মেধার মান কমিয়ে নিচ্ছেন না। যদি একাধিক সুযোগ দিয়ে একই মেধার শিক্ষার্থী নেন, তাহলে সেই ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের আপত্তি থাকা উচিত না। আমরা যেমন কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে বয়সের যে বাধা ছিল, সেটাও তুলে দিয়েছি।’ এ সময় তিনি বৈশ্বিক চিত্র তুলে ধরে বলেন, এগুলোর কোনোটাই কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। যে কোনো পর্যায় থেকে যে কেউ যেন একটা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান, সেই সুযোগটা আমাদের করে দিতে হবে।
