সাধারণত দলের স্থায়ী কমিটিতে কর্মকৌশল, আন্দোলন ও সাংগঠনিক কার্যক্রমের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরপর দলের বাকিদের ডেকে সেই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিতেন। ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম ছিল। বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে গৃহীত সিদ্ধান্তই জোটের বৈঠক ডেকে জানিয়ে দিতেন তিনি। এবার খালেদা জিয়ার এই নিয়মে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। প্রত্যেকটি কাজেই সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততা শতভাগ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। বিএনপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। পাশাপাশি গত তিন মাসে তার রাজনৈতিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করেও এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন কার্যালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এতদিন খালেদা জিয়া দলের স্থায়ী কমিটির বাইরে উপদেষ্টা, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম-মহাসচিব, সাংগঠনিক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সঙ্গে বৈঠক করলেও পরামর্শ চাইতেন খুব কম। এর মধ্যে বেশিরভাগ বৈঠকেই দলীয় সিদ্ধান্ত তিনি নেতাদের ডেকে এনে জানিয়ে দিতেন। যদিও ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে নিজের এই অবস্থানে পরিবর্তন আনেন তিনি। ১৮ নভেম্বর নতুন ইসি গঠনের প্রস্তাব ও নতুন ইসি নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে দেওয়া প্রস্তাবনা তৈরির কাজে সংশ্লিষ্টদের যুক্ত করেন খালেদা জিয়া। দলের সিনিয়র নেতা ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত নিয়েই তিনি রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে প্রস্তাবনাটি উত্থাপন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ইসিতে একজন নারী সদস্য নিয়োগের প্রস্তাব। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতিকে আরও কয়েকটিদলও নারী সদস্য রাখার প্রস্তাব করে।
দলের চেয়ারপারসনের এই পরিবর্তন বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘খালেদা জিয়া আগে থেকেই সবার সঙ্গে কথা বলতেন। দলের সাংগঠনিক ও আন্দোলন সংগ্রামের বিষয়েও আলোচনা করতেন। বিষয়টি হয়তো এখন আরও বেড়েছে।’
বিএনপিপন্থী
বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, ‘খালেদা জিয়ার এই পরিবর্তন গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য সহায়ক হবে।’
সূত্র জানায়, ১১ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাতে ভাইস চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। এ বৈঠকের শুরুতেই তিনি ভাইস চেয়ারম্যানদের কাছে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিএনপির করণীয় জানতে চান। নেতারা তাদের স্ব-স্ব বক্তব্য উপস্থাপন করেন এবং দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নোট করেছেন। ভাইস চেয়ারম্যানদের বৈঠকে খালেদা জিয়া সবার বক্তব্য শুনে নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।
ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী জানান, ‘বৈঠকে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আলোচনা হয়েছে। খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে কয়েকটি পরামর্শ এসেছে।’ এদিকে চেয়ারপারসনের কার্যালয় সূত্র বলছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সবার সঙ্গে আগামী দিনের রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে বৈঠক করবেন খালেদা জিয়া। একই ধারাবাহিকতায় ১২ ফেব্রুয়ারি রবিবারও দলের উপদেষ্টাদের সঙ্গে বসবেন তিনি।
২০ দলীয় জোটসূত্র জানায়, গত ২৯ জানুয়ারি রবিবার স্থায়ী কমিটির এ বছরের প্রথম বৈঠক থেকেই ইসির জন্য সার্চ কমিটিতে নাম প্রস্তাব প্রসঙ্গে তাদের ফোন করে মতামত জানতে চাওয়া হয়। খালেদা জিয়ার পরামর্শেই তাদের ফোন করেছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ বিষয়টিও জোটে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পরের দিন ৩০ জানুয়ারি জোটভুক্ত শরিক দলের নেতাদের ডেকে নিয়ে নাম বিষয়ে আলোচনা করেন মির্জা ফখরুল। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার নির্দেশনা ছিলে বলে সূত্র জানায়।
জোটশরিক বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি বলেন, ‘বৈঠক থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আমাকে ফোন করেছিলেন। খুব সম্ভবত, ওই সময় স্থায়ী কমিটির বৈঠক চলছিল।’
বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, আগামী দিনে বিএনপির কর্মকৌশল কী হবে, এ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতেই নেতাদের নিয়ে বসছেন খালেদা জিয়া। বিএনপির পর জোটের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। জানা গেছে, ইসি নিয়ে খালেদা জিয়াও কথা বলতে পারেন গণমাধ্যমে।
২১ জানুয়ারি জিয়া পরিষদের প্রতিনিধি সম্মেলন উপলক্ষে মতবিনিময় সভায়ও খালেদা জিয়া গবেষণার কাজে মনোযোগী হতে উপস্থিত শিক্ষকদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। ওই সভায় তিনি বলেছেন, ‘আপনারা কী গবেষণা করছেন, দিন। আমরা দেখি। এগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেই। ওই সভায় তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এবং তার ও তার দলের নেতাদের সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানানোর পরামর্শ দেন।’
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ইসি গঠনে প্রস্তাব দেওয়ার মতো সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েও প্রস্তাব দেবেন বিএনপি। খালেদা জিয়ার আগ্রহে অনেকটাই ছায়া সরকারের দায়িত্ব পালন করতে চায় দলটি। বিগত বছরের শেষ দিকে তিনি কয়েকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সংস্কারের বিষয়ে প্রস্তাব দিতে সংশ্লিষ্টদের প্রস্তুতি নিতে বলেন। এরই মধ্যে সরকারি কর্মকমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়েই আগামী দিনে বিএনপির প্রস্তাব প্রকাশিত হবে।
এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘এটি তো খুব স্বাভাবিক, দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এখন সরকার পরিবর্তন হলে, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেলে সরকারই পারফরমেন্স করতে পারবে না। এজন্য রিফর্মস প্রোগ্রাম চলতে থাকবে। এ কারণে আমরা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছি।’
চেয়ারপারসনের কার্যালয় সূত্র বলছে, আগামী দিনে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক আচরণে আরও চমক দেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলোর অপ্রত্যাশিত পরিণতি হলেও দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে আরও পরিবর্তন আনতে পারেন।
সূত্রের দাবি, সামনের দিনে দলের পরিস্থিতি উন্নয়ন ও সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থান নির্ণয় করতে খালেদা জিয়া দলের সমর্থিত বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবীদের কাছেও পরামর্শ চাইবেন । বাংলা ট্রিবিউন।