Friday, March 29

অশনি সংকেত সাত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে

দুর্নীতির দায়ে ডুবতে বসেছে ৭টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বিতরণ করা ঋণের সর্বনিু ৪২ থেকে সর্বোচ্চ ৯৬ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে। এছাড়া আরও ৯টি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।

খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি বন্ধ না হলে নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাই সবকিছুর আগে কঠোরহস্তে প্রভাবশালীদের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। তা না হলে এ খাত বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিষ্ঠান সাতটি হচ্ছে-বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিডেট, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেড এবং উত্তরা ফাইন্যান্স লি.।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে নিশ্চয় প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিক যোগসাজশে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। তা না হলে এমন করুণ পরিস্থিতি হতো না। এছাড়া পরিচালক এবং শীর্ষ ব্যবস্থাপনারও দায় আছে। সার্বিকভাবে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানে হরিলুট হয়েছে সেগুলো ছাড়া নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপি ঋণ ৭ শতাংশে নেমে আসবে। এটা ভালো প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় ধরনের কষ্টের। এতদিন দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি ঋণও লুকিয়ে রেখেছিল। এখন সব বের হচ্ছে। সে কারণে খেলাপি ঋণ ১৯ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তিনি বলেন-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে আস্থা ফেরানো সম্ভব হবে না। একইসঙ্গে দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) ঋণস্থিতি ছিল ১৬৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় পুরো টাকাই খেলাপি (৯৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ) হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের লুটপাট এবং অর্থ আত্মসাৎ করার প্রমাণ মিলেছে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এছাড়া ডিসেম্বর পর্যন্ত ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ঋণস্থিতি ছিল ৯৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৮৭১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৯০ শতাংশ ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। একইভাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ঋণ ছিল ১৯২৮ কোটি টাকা।

এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১৭১৪ কোটি টাকা। যা ৮৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। ফার্স্ট ফাইন্যান্সের ঋণ ছিল ৮৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৭৪২ কোটি টাকা। যা ৮২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) ঋণ ছিল ৪ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৩২১০ কোটি টাকা। যা ৭৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডের ঋণ ছিল ১৩৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৪৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং উত্তরা ফাইন্যান্সের ঋণ ছিল ২ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৪১ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আইআইডিএফসির ঋণ ছিল ১৩৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৪৮৮ কোটি টাকা। যা ৩৫ দশমিক ০৩ শতাংশ। দ্য ইউএই বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের ঋণস্থিতি ছিল ৪০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বা ২৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ঋণস্থিতি ছিল ১১৭১ কোটি টাকা।

এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৩২০ কোটি টাকা বা ২৭ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং আভিভা ফাইন্যান্সের ঋণস্থিতি ছিল ২৬৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এছাড়া ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাইম ফাইন্যান্স খেলাপি ১৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স ১৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ফিনিক্স ফাইন্যান্স ১৪ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং মাইডাস ফাইন্যান্সের ১৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। শুধু খেলাপি নয়, নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৬টি নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতিতে সব চেয়ে বেশি নাজুক অবস্থায় আছে এফএএস (ফাস) ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিল ১০৬৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। করেছে মাত্র ১৯৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। সে হিসাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত এফএএস (ফাস) ফাইন্যান্সের প্রভিশন ঘাটতি ৮৭২ কোটি ৮১ লাখ টাকা। যা খুবই অস্বাভাবিক। একইভাবে ফার্স্ট ফাইন্যান্সের প্রভিশন ঘাটতি ১৫৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডের প্রভিশন ঘাটতি ১৪০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আইআইডিএফসির প্রভিশন ঘাটতি ৯০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। আভিভা ফাইন্যান্সের প্রভিশন ঘাটতি ২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং ইসলামিক ফাইন্যান্সের প্রভিশন ঘাটতি ৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।

২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার ৩৫৪ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১৩ হাজার ১৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

Leave a Reply