Friday, April 26

সামনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংঘাতময় হয়ে উঠেছে রাজনীতি। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে সংঘর্ষ। কর্মসূচিতে প্রতিদিনই হামলার শিকার হচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।

সংঘর্ষে জড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও পুলিশ। এসব কর্মসূচিতে বাধার পাশাপাশি নেতাকর্মীদের বাড়িঘর এমনকি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও চালানো হচ্ছে হামলা। রেহাই পাচ্ছেন না কেন্দ্রীয় নেতারাও।

যেখানে হামলা সেখানেই হচ্ছে মামলা। চলছে গ্রেফতারও। পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিনই রাজনৈতিক বাহাসে জড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা। সেখানে থাকছে রাজপথ দখল ও পালটা দখলের হুঁশিয়ারি।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা-সামনের দিনগুলোতে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়া সংঘাত চলে আসতে পারে রাজধানীতে।

বিএনপির দেওয়া তথ্য ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২২ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া কর্মসূচিতে রোববার পর্যন্ত ৪১টি সমাবেশে হামলা চালানো হয়।

বিএনপির ৪ হাজার ৮১ নেতাকর্মীর নামোল্লেখ করে মামলা দেওয়া হয়েছে। এতে প্রায় ২০ হাজার অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে ২০০ জনকে।

স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২৫টি স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। হামলায় একজন নিহত ও ২ হাজার নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে অন্তত ৫০টি স্থানে।

জানতে চাইলে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশে যা হচ্ছে এটাকে রাজনীতি বলা যায় না। এটা অপরাজনীতি। কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা দিয়েছে।

এই মুহূর্তে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর পালটাপালটি কর্মসূচি ও বাহাসে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে আমাদের জন্য ঘোর অন্ধকার অপেক্ষা করছে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। একে অপরকে ঘায়েলের কৌশল নিয়ে তারা ব্যস্ত। ক্ষমতাসীন দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা চালাচ্ছে।

কিন্তু এক সময় বিএনপিও পালটা আঘাত করতে পারে। তখন পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। দেশের মানুষ সে ভয়ংকর দিন দেখতে চায় না।

তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে দ্রুত আলোচনায় বসতে হবে। রাজপথে রাজনীতির সাময়িক জয়-পরাজয় হতে পারে। কিন্তু চূড়ান্ত সমঝোতা আলোচনার টেবিলেই হতে হবে।

তৃণমূলে সংঘাত ছড়িয়ে পড়লেও তা বন্ধে কোনো পক্ষকেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। উলটো প্রতিনিয়ত একে-অপরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।

যেখানেই তারা কথা বলছেন ঘুরেফিরে স্থান পাচ্ছে রাজনৈতিক উত্তেজনাই। বক্তৃতা-বিবৃতিতে শক্তির মহড়া দিচ্ছেন দুদলের নেতারা।

শুক্রবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি গায়ে পড়ে আক্রমণ করব না। কিন্তু আমি যদি তাদের দ্বারা আক্রান্ত হই, তখন নিজেকে রক্ষা করতে পালটা জবাব দিতে হবে। আওয়ামী লীগ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ জবাব দেবে।’

শনিবার ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উদ্দেশে বলেন, ‘আন্দোলন করতে করতে মির্জা ফখরুল সাহেব গলা শুকিয়ে ফেলছেন। কিন্তু মরা নদীতে তো জোয়ার আসে না। কোন মুখে বলেন ফয়সালা হবে। ফয়সালা হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফাইনাল খেলায়। তখন দেখা যাবে কে হারে কে জেতে। রাজপথে হুমকি দিয়ে লাশ ফেলতে চান। আপনারা লাশ ফেলার দুষ্টচক্রে ঢুকে গেছেন।’

বিএনপিকে মোকাবিলার জন্য রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী যুবলীগ। জামায়াত-বিএনপির নৈরাজ্যের প্রতিবাদে শুক্রবার রাজধানীতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে যুবলীগ।

এ সময় যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে সামস পরশ বিএনপিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘আজ থেকে তারা মাঠে থাকবেন। নৈরাজ্য, সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্রের জবাব দেবেন। তারা যদি জনগণের জানমালের ক্ষতি করার চেষ্টা করে তাহলে যুবলীগের প্রত্যেক নেতাকর্মী রাজপথে থেকে তার দাঁতভাঙা জবাব দেবেন।’

বসে নেই বিএনপির নেতারাও। শুক্রবার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের এবার হচ্ছে শেষ লড়াই। এবার আমাদের জীবনমরণ লড়াই করতে হবে। হয় জীবন না হয় মরণ।’

শনিবার নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক প্রতিবাদ সমাবেশে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আরেকটি পাতানো নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। সে কারণে আবার তারা বিরোধী দলের ওপর চড়াও হতে শুরু করেছে। গুলি, ভাঙচুর এবং হত্যা করে বিরোধী দলকে মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে চায়। মাঠের ভেতরে একা থেকেই আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে চায়। এবার আর তা হবে না। আমরা এবার কোনোমতেই পরাজিত হব না। কারণ, এবার বিজয় লাভ করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন একই অনুষ্ঠানে বলেন, ‘সংকটের সমাধান হবে রাজপথে। রাজপথে আমাদের সেইভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।’

জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এখন রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা বলে কিছু নেই। আছে প্রতিহিংসা। এ প্রতিহিংসারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি।

রাজনীতিতে হুঙ্কার, পালটা হুঙ্কার চলবে। কিন্তু মাইর হবে একতরফা। হাতে লাঠি থাকবে, মাঠ দখল করতে দেওয়া হবে না-এসব কথাবার্তা হবে। তবে এসবে আমরা অভ্যস্ত।

নির্বাচন যত কাছাকাছি আসবে ততই এটা বাড়তে থাকবে। সংঘাত হলে সাধারণ মানুষ ভুগবে। কিন্তু তারা তো এদের নিয়ে ভাবে না। ভাবলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না।

সংকট নিরসনে ভাবা উচিত না অনুচিত সেটা ভেবে রাজনীতিবিদরা কাজ করে না। যারা এসব সহিংস ঘটনার চিত্রনাট্য লেখে এবং পরিচালনা ও প্রযোজনা করেন তারা খুব ভালো আছেন। তাদের আরও ভালো হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর শুভবুদ্ধির উদয় হবে বলে মনে হয় না। সামনে ভালো কিছুর জন্য আল্লাহর রহমত কামনা করি।

জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের মূলবৃদ্ধি এবং ভোলায় দুই নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে ২২ আগস্ট থেকে তৃণমূলে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি।

কর্মসূচির প্রথম দিন থেকেই ক্ষমতাসীন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে বিএনপি। ওই দিনেই ফেনীতে শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর বাড়িতে হামলা চালানো হয়।

এছাড়া বরিশালের গৌরনদী ও জামালপুরের মাদারগঞ্জে বিএনপির কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ উঠে। পরের দিন বিএনপির কর্মসূচি ঠেকাতে পালটা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠন।

ওই দিন ফেনীর পরশুরাম ও পটুয়াখালীর দুমকিতে একই স্থানে দুদলের কর্মসূচি থাকায় স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। ২৪ আগস্ট ঠাকুরগাঁও ও টাঙ্গাইলে সমাবেশে হামলা চালানো হয়। এতে অর্ধশত নেতাকর্মী আহত হন।

বগুড়ার নন্দীগ্রামে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। তবে বিএনপির কর্মসূচি শুরুর পর ২৬ আগস্ট বাঁশখালি, নোয়াখালীসহ দেশের ১০ জেলায় হামলা চালানো হয়। এতে দেড় শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন।

২৭ আগস্ট যশোরে দলের স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য তরিকুল ইসলাম, জেলার সাধারণ সম্পাদক সাবেরুল ইসলাম সাবু, মিজানুর রহমানের বাড়িতে একযোগে হামলা চালানো হয়।

৩০ আগস্ট ফেনীর দাগনভূঁইয়ায় সমাবেশে যাওয়ার পথে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টুর গাড়িবহরে হামলা চালানো হয়। তবে এ পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ১ সেপ্টেম্বর।

ওই দিন নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে র‌্যালিতে হামলা চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের গুলিতে নিহত হন যুবদলকর্মী শাওন।

শনিবার ঠাকরগাঁও ও কিশোরগঞ্জে ক্ষমতাসীন দলের হামলায় বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। রোববারও ফরিদপুর ও বরগুনায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।

Leave a Reply