হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে পতন হয়েছে পুলিশ লীগের। ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের পতনের পর একে একে চাকরি ফিরে পান পুলিশের অনেক কর্মকর্তা। তবে তারা পুলিশ নয়, আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী হিসেবে আবির্ভূত হন। পুলিশের পোশাক পরে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার অ্যাজেন্ডা নিয়ে গড়ে তোলেন ‘পুলিশ লীগ’। তাদের ব্যবহার করেন পুলিশের আওয়ামীপন্থি শীর্ষ কর্মকর্তারাও।
শেখ হাসিনার পতনের পর পরিবর্তন আনা হয়েছে পুলিশের অধিকাংশ ইউনিটের শীর্ষ পদে। তবে এবার পুনর্বহাল হচ্ছেন আওয়ামী আমলে চাকরিচ্যুত পুলিশ কর্মকর্তারা। তারাও বেপরোয়া হতে পারেন, গড়ে তুলতে পারেন ‘পুলিশ দল’-এমন আশঙ্কার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিএনপির আমলে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন অনেক পুলিশ সদস্য এ তালিকায় সবচেয়ে আলোচিতরা হলেন-ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান ডিআইজি মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ, ডিএমপির যুগ্মপুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, অ্যাডিশনাল ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ঢাকা জেলার সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, সাবেক এসবি প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম প্রমুখ।
২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের পতনের পর একে একে চাকরি ফিরে পেয়ে আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী হিসেবে আবির্ভূত হন তারা।
পুলিশ লীগের এমন অন্তত ২০ জন কর্মকর্তা ছিলেন সবচেয়ে বেপরোয়া। তাদের তাণ্ডবে তটস্থ ছিল পুরো পুলিশবাহিনী। ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমাতে নির্যাতনের মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে এ পুলিশ লীগকে ব্যবহার করে সদ্যবিদায়ি আওয়ামী লীগ সরকার। আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশ থেকে পালানোর পর পালটে যায় দৃশ্যপট।
আত্মগোপনে চলে যান পুলিশ লীগের ক্যাডাররা। ছাত্র-জনতার ভয়াবহ হামলার শিকার হয় পুলিশ বাহিনী। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে পুলিশ। পরিবর্তন আনা হয়েছে অধিকাংশ ইউনিটের শীর্ষ পদে। তবে এবার পুনর্বহাল হচ্ছেন আওয়ামী আমলে চাকরিচ্যুত পুলিশ কর্মকর্তারা। তারাও বেপরোয়া হতে পারেন, গড়ে তুলতে পারেন ‘পুলিশ দল’-এমন আশঙ্কার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা যুগান্তরকে বলেন, সরকারি চাকরি যারা করে, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কিন্তু রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থের জন্য তাদের ব্যবহার করেছে। তখন অনেকেই পাবলিক সার্ভেন্ট বা জনসেবক থাকেননি। তারা ডমেস্টিক সার্ভেন্ট (গৃহভৃত্য) হয়ে গেছে। গৃহভৃত্য আর রাষ্ট্রের সেবা করা ভৃত্য এক জিনিস নয়। দোষটা মূলত রাজনীতিকদের। তারা পরস্পরকে প্রতিযোগী মনে করে না, শত্রু মনে করে। সেটার প্রতিফলন তাদের কাজের মধ্যে হয়। এটা মোটেই কাঙ্ক্ষিত না।
সরকার বদলের সঙ্গে পুলিশের কারও কারও চাকরি চলে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, রাজনীতিকরা মনে করে এ লোকগুলো আমাদের না। বাড়ি ফরিদপুর হলে সে আমার লোক না। বাড়ি বগুড়া হলে সে আমার লোক না। এসব ধারণা থেকে রাজনীতিকরা বের হতে পারলে এগুলো থাকবে না।
জানা যায়, আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষদিকে অনুষ্ঠিত হয় ২০ ও ২১তম বিসিএস পরীক্ষা। এর মধ্যে ২০তম বিসিএস-এর কর্মকর্তারা সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ২০০১ সালে সারদায় পাসিং আউটের মাধ্যমে চাকরিতে যোগদান করেন। তবে এ ব্যাচে রাজনৈতিক বিবেচনায় ১২ কর্মকর্তা বরখাস্ত হন। তাদের মধ্যে অন্যতম সাবেক ডিএমপির ডিবিপ্রধান ও ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সদস্য হারুন অর রশীদ এবং গোপালগঞ্জের বাসিন্দা রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি থেকে সদ্যবিদায়ি মো. আনিসুর রহমান।
এছাড়া এফ রহমান হলের সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি সৈয়দ নুরুল ইসলাম যোগদানের কয়েকদিনের মধ্যেই চাকরিচ্যুত হন। পরে বিএনপি সরকারের পতনের পর সবাই চাকরি ফিরে পান। চাকরি ফিরে পেয়ে তারা হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। পুলিশ লীগের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় সৈয়দ নুরুল ইসলামকে।
এদিকে ২১তম বিসিএস-এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০০০ সালে আওয়ামী লীগের আমলে। তবে রিটেন ও ভাইভার ফল প্রকাশ হয় বিএনপি আমলে। চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন ৫৩ জন। ২০০৩ সালে বিএনপির আমলে সারদায় ট্রেনিং শেষে পাসিং আউটে আটকে যান এ ব্যাচের ৮ কর্মকর্তা। এছাড়া ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব কুমার সরকার চাকরিতে যোগদানের ছয় মাসের মাথায় আমেরিকা চলে যান। পরে তাকে বরখাস্ত করা হয়।
বিসিএস ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা ২০০৫ সালে চাকরিতে যোগদান করলেও ওই ব্যাচের প্রলয় কুমার জোয়ারদার বরখাস্ত হন। পরে বিএনপি সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর ২৭ বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সারদায় ট্রেনিং করে পাসিং আউটের মাধ্যমে চাকরিতে যোগদান করেন। বিসিএস ১৭ ব্যাচের কর্মকর্তা সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগের আমলে চাকরিতে যোগদান করেন। পরে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে বরখাস্ত হন। ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম ১৯৯৫ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। তিনিও ২০০১ সালে বিএনপির সময় চাকরিচ্যুত হন। বিএনপি সরকারের পতনের পর ফের চাকরি ফিরে পান।
অভিযোগ রয়েছে, এসব কর্মকর্তাই আওয়ামী লীগের পুরো আমলে ছিলেন বেপরোয়া। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মদদে এবং সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম ও সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামানের আশকারায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে পুলিশ লীগ।
হারুন, নুরুল ইসলাম ও বিপ্লবদের পুলিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে বাসায় ওই সিন্ডিকেটই। বিরুদ্ধ মত দমন, আওয়ামী লীগের বিরোধী পক্ষ বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতকে কোণঠাসা করতে বেশি ভূমিকা রেখেছে এ সিন্ডিকেট। সরকারি চাকরি করেও পুলিশ লীগ হয়ে কাজ করে অনেকে হয়েছেন অঢেল সম্পদের মালিক। মেট্রোপলিটনসহ বিভিন্ন জেলা ইউনিটে এসপি পদে পদায়নেও গুরুত্ব পেয়েছে পুলিশ লীগের একনিষ্ঠ সদস্যরা।
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে সবচেয়ে সমালোচিত ভাতের হোটেল খ্যাত মিন্টু রোডের ডিএমপির ডিবি কার্যালয় এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন ডিআইজি হারুন-অর-রশীদ। অভিযোগ রয়েছে, এ সময় বিরোধী মতকে দমন, আটক বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন ডিবির অনেক সদস্য। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান এক প্রকার জোর করেই ওই পদে বসান হারুনকে।
ডিবির দায়িত্ব নিয়ে তার মনঃপূত ডিসি, এডিসি ও এসিদের নিয়ে গড়ে তোলেন এক দানব বাহিনী। রাজধানীতে বিএনপি-জামায়াতের যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের আগে গণগ্রেফতারের মূল দায়িত্ব ছিল হারুনের।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জানের ধানমন্ডির বাসায় গভীর রাত পর্যন্ত পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের নিয়ে করা বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব ছিল হারুনের। এছাড়া কমিশনের বিনিময়ে পাওনাদারদের কাছে টাকা আদায় করা রেওয়াজে পরিণত করেন হারুন।
ডিবিতে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভালো পারফর্ম করতে পারা কর্মকর্তারা পেয়েছেন প্রাইজ পোস্টিং। তাদের মধ্যে অন্যতম মো. আসাদুজ্জামান (ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার), ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের সাবেক ডিসি এইচএম আজিমুল হক ও নারায়ণগঞ্জের সাবেক পুলিশ সুপার গোলাম মস্তফা রাসেল।