
ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের মেয়ে শাজনীন তাসনিম রহমানকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শহীদুল ইসলামের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
২৯ নভেম্বর বুধবার রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সংবাদমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিনিয়র জেলা সুপার মিজানুর।
এর আগে জেলার বিকাশ রায়হান জানিয়েছিলেন, রাতেই আসামির দণ্ড কার্যকরের সময় গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাহেনুল ইসলাম, গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. সৈয়দ মো. মঞ্জুরুল হকসহ পুলিশের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার উপস্থিত থাকার কথা।
১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল রাতে গুলশানে নিজ বাড়িতে খুন হন শাজনীন তাসনিম রহমান। পরদিন শাজনীনের বাবা লতিফুর রহমান গুলশান থানায় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় একটি হত্যা মামলা করেন।
একই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ওই ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করে সিআইডি।
তদন্ত শেষে প্রথম মামলায় ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত-১ এবং দ্বিতীয় মামলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। দুটি মামলাতেই আদালত অভিযোগ গঠন করেন।
পরে দুটি মামলারই অভিযোগ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করেন আসামিরা। ১৯৯৯ সালের ৬ জুলাই বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল করিম ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের (পরে প্রধান বিচারপতি) সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায়ে বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজের আদালতে বিচারাধীন হত্যা মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত থাকবে।
কারণ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে ইতিমধ্যে আসামিদের খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে বিচারাধীন ধর্ষণ ও হত্যা মামলাটির কার্যক্রম চলবে।
ওই রায়ে হাইকোর্ট বলেন, ধর্ষণ ও হত্যা দুটি পৃথক অপরাধ, একটি আরেকটি থেকে আলাদা। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল বিভাগে যান।
১৯৯৯ সালের ১১ নভেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, বিচারপতি লতিফুর রহমান (পরে প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি এ এম মাহমুদুর রহমান ও বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরীর (পরে প্রধান বিচারপতি) সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগের বেঞ্চ আসামিদের আপিল আবেদন খারিজ করে দেন।
সর্বোচ্চ আদালত রায়ে বলেন, হাইকোর্ট সঠিকভাবেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে চলা মামলাটির কার্যক্রম চালানোর নির্দেশ দিয়ে অন্য মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বলেছেন। এটা এমন একটি মামলা, যেখানে ধর্ষণের সময় হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। বরং স্পষ্টত এখানে প্রথমে ধর্ষণ ও পরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ধর্ষণ ও হত্যা দুটি আলাদা অপরাধ এবং এ ক্ষেত্রে একই অপরাধে দুবার বিচার হওয়ার ঘটনা ঘটবে না।
সর্বোচ্চ আদালত থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে মামলাটির বিচার চলতে থাকে। ২০০৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের বিচারক কাজী রহমতউল্লাহ মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। রায়ে শাজনীনকে ধর্ষণ ও খুনের পরিকল্পনা এবং সহযোগিতার দায়ে ছয় আসামিকে ফাঁসির আদেশ দেন আদালত।
বিচারিক আদালতের রায়ের পর মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য মামলাটি হাইকোর্টে যায়। একই সঙ্গে আসামিরাও আপিল করেন। ২০০৬ সালের ১০ জুলাই হাইকোর্ট পাঁচ আসামি হাসান, শহীদ, বাদল, মিনু ও পারভীনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন।
এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন (লিভ টু আপিল) করেন চার আসামি হাসান, বাদল, মিনু ও পারভীন। ২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল সাজাপ্রাপ্ত চার আসামির লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ। ফাঁসির আদেশ পাওয়া আরেক আসামি শহীদ জেল আপিল করলে তা খারিজ করে দেন আদালত।
হত্যাকাণ্ডের প্রায় ১৮ বছর পর গত বছরের ২৯ মার্চ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের বেঞ্চে হাইকোর্টে ফাঁসির আদেশ পাওয়া আসামিদের আপিলের শুনানি শুরু হয়। তিন সদস্যের ওই বেঞ্চের অপর দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
গত ৫ এপ্রিল বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মো. ইমান আলীকে যুক্ত করে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ গঠন করা হয়। ৬ এপ্রিল থেকে ওই বেঞ্চে আসামিদের আপিল শুনানি শুরু হয়।
২ আগস্ট আসামিদের মধ্যে শহীদুল ইসলাম শহীদের ফাঁসির রায় বহাল রেখে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। বাকি চারজনকে খালাস দেন আপিল বিভাগ। খালাসপ্রাপ্তরা হলেন- হাসান, বাদল, মিনু ও পারভীন।