Friday, April 19

শিশুর নৈতিকতা গঠনে পারিবারিক শিক্ষা ও পর্দা অনুশীলনের গুরুত্ব- পর্ব- ০২

তিন. সদুপদেশ প্রদান:
মাতাপিতার সদুপদেশ সন্তানের জীবনপথের পাথেয় ও অন্ধকারে আলোকরশ্মি। তা নিষ্পাপ শিশুর উর্বর হৃদয়ে তা অঙ্কিত হয়ে থাকে সারাজীবন। জীবনের গতিপথ নির্ধারণের ক্ষেত্রে এগুলোই তাকে দেয় সঠিক নির্দেশনা।

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি একদা রাসূলুল্লাহ্সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পেছনে আরোহণ করেছিলাম। তিনি বললেন, হে বালক, আমি তোমাকে কিছু (মুল্যবান) কথা শিক্ষা দেব:

* তুমি আল্লাহ তা‘আলার হক আদায়ের ব্যাপারে যত্নশীল হও, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতের অনিষ্ট থেকে হিফাযত করবেন।

* যখন কিছু প্রার্থনা করবে, আল্লাহর কাছেই করবে।

* যখন সাহায্যের আবেদন করবে, তখন একমাত্র আল্লাহর কাছেই করবে।

* জেনে রাখ, যদি গোটা জাতি তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তাহলে তারা ততটুকুই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তা‘আলা তোমার জন্য বরাদ্দ করেছেন। আর তারা যদি তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায়, তাহলে ততটুকুই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার নামে বরাদ্দ করেছেন। কলম তুলে নেওয়া হয়েছে আর নিবন্ধন বই শুকিয়ে গেছে অর্থাৎতাকদীরে যা বরাদ্দ হবার তা হয়ে গেছে।[16]

ইবরাহীম ও ইয়াকুব আলাইহিমাস সালামনিজ সন্তানদের উপদেশ সম্পর্কে কুরআনে এসেছে, “এরই অসিয়ত করেছে ইবরাহীম তাঁর সন্তানদের এবং ইয়াকুবও যে, হে আমার সন্তানগণ! নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের জন্যে এ দীনকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলিম না হয়ে কখনও মারা যেও না।”[সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৩২]

লোকমান হাকীম প্রদত্ত উপদেশ:

“যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বলল, হে বৎস, আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়। আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধছাড়ানো দু’বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে। পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহাবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমাদের প্রত্যবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করব। হে বৎস, কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তত গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ গোপনভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন। হে বৎস, সালাত কায়েম করো, সৎকাজের আদেশ দাও, মন্দকাজে থেকে নিষেধ করো এবং বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করো। নিশ্চয়ই এটা সাহসিকতার কাজ। অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না।নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করে না। পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর নিচু করো। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।”[সূরা লোকমান,আয়াত: ১৩-১৯]

৪. সন্তানের কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করা:
ইবরাহীম আলাইহিস সালামদো‘আ করেছিলেন, “হে আমার পালনকর্তা, আমাকে সালাত কায়েমকারী করুন এবং আমার সন্তানদের মধ্যে থেকেও। হে আমার পালনকর্তা, এবং কবুল করুন আমাদের দো‘আ।”[সূরা ইবরাহীম,আয়াত: ৪০]

ইসলামেরএসুমহান নির্দেশনাবলীর আলোকে যারা প্রতিপালিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবে, তারাই হবে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তারা কখনোই কাউকে উত্ত্যক্ত করতে পারে না। পিতা-মাতাগণ যদি তাঁদের সন্তানদেরকে নৈতিকতার অনুশীলন বাড়িতেই নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে অনাচারমুক্ত সভ্য সমাজ গঠন অসম্ভব হবে না।

৫. রাস্তার হক আদায় করা:
ইসলাম মানুষকে সার্বক্ষণিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে রাস্তাঘাটে বসতে নিষেধ করেছেন। একান্ত বসতে হলে রাস্তার হক আদায় করতে হবে। আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, “সাবধান, তোমরা রাস্তায় বসবে না। তখন সাহাবীগণ বললেন, আমাদের এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমরা রাস্তায় বসে পরস্পর দীনী আলোচনা করি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি তোমরা একান্তই রাস্তায় বসতে চাও তাহলে রাস্তার হক আদায় করবে। সাহাবীগণ বললেন, রাস্তার হকসমূহ কী? আল্লাহর রাসূল বললেন, ১. চক্ষু অবনমিত করে রাখা ২. কাউকে কষ্ট না দেওয়া ৩. সালামের উত্তর দেওয়া ৪. সৎ কাজের আদেশ করা এবং ৫. মন্দ কাজে নিষেধ করা।”[17]

আমরা যদি আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে রাস্তায় চলাফেরার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনাকে অনুসরণের তাগাদা দিতে পারি, তাহলে নিশ্চয়ই রাস্তাঘাটের অনাকাঙ্খিত ঘটনা থেকে আমাদের সন্তানরা নিরাপদ থাকতে পারবে।

৬. আল্লাহভীতি:
যার মধ্যে তাকওয়া কাজ করে তিনি কখনো খারাপ কাজ করতে পারেন না। একজন মুত্তাকী মানুষ তার সকল কাজে আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করেন। তিনি জানেন, তাকে দেখছেন, শুনছেন, পর্যবেক্ষণ করছেন। আল্লাহর কাছে বান্দার গোপনীয়তা বলতে কিছুই থাকে না।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “যা কিছু আকাশসমূহে এবং যা কিছু জমিনে আছে, সব আল্লাহরই। যদি তোমরা মনের কথা প্রকাশ কর কিংবা গোপন কর, আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নেবেন। অতঃপর যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা তিনি শাস্তি দিবেন।”[সূরা আল-বাকারা: ২৮৪]

“হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলে।”[সূরা আল-আহযাব,আয়াত: ৭০]

আবু যররাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আবদুর রহমান বলেছেন, হে আল্লাহর রাসূল আমাকে উপদেশ দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় করো। খারাপ কাজের পরপরই ভালো কাজ করো এবং মানুষের সাথে উত্তম ব্যবহার কর।”[18]

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, “বলুন, হে আমার ঈমানদার বান্দাগণ! তোমরা তোমাদের রবের তাকওয়া অবলম্বন করো। যারা এ দুনিয়াতে সৎকাজ করে, তাদের জন্য রয়েছে পূণ্য। আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত। যারা ধৈর্য ধারণকারী, তারাই তাদের পুরস্কার পায় অগণিত।”[সূরা আয-যুমার,আয়াত: ১০]

তিনি আরো বলেন, “যেদিন(কিয়ামতের দিন)‘আরশের ছায়া ছাড়া আর অন্য কোনো ছায়া থাকবে না সেদিনসাত প্রকার লোককে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর আরশের ছায়ায় স্থান দিবেন।

ন্যায়পরায়ণ নেতা,
ঐ যুবক, যে তাঁর যৌবনকাল আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছেন,
এমন ব্যক্তি, যার অন্তর মসজিদের সাথে লটকানো থাকে, একবার মসজিদ থেকে বের হলে পুনরায় প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত ব্যাকুল থাকে,
এমন দু’ব্যক্তি, যারা কেবল আল্লাহর মহব্বতে পরস্পর মিলিত হয় এবং পৃথক হয়,
যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহর ভয়ে চোখের অশ্রু ফেলে,
যে ব্যক্তিকে কোনো সম্ভ্রান্ত বংশের সুন্দরী রমণী ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আহবান জানায় আর ঐ ব্যক্তি শুধু আল্লাহর ভয়েই বিরত থাকে এবং
যে ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কী দান করল বাম হাতও তা জানল না।” [19]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও সম্পদের দিকে তাকান না; কিন্তু তিনি তোমাদের অন্তর ও কর্মের দিকে তাকান।” [20]
চলবে………

Leave a Reply