Thursday, April 25

রোহিঙ্গাদেরকে দুনিয়া থেকেও নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল মিয়ানমার

রোহিঙ্গাদের শুধু রাখাইন রাজ্য থেকেই নয়, দুনিয়া থেকেও নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্য ছিল মিয়ানমারের। এ কারণে মিয়ানমার বাহিনী রোহিঙ্গাদের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার প্রাক্কালেও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অনুরোধে গত মার্চ ও এপ্রিলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে তাদের ওপর নৃশংসতার জবানবন্দি গ্রহণকারী ও তদন্তকারী আইনি প্রতিষ্ঠান ‘পাবলিক ইন্টারন্যাশনাল ল’ অ্যান্ড পলিসি গ্রুপ (পিআইএলপিজি)’ এ মূল্যায়ন করেছে।

পিআইএলজির একজন তদন্তকারী বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের নির্মূল করা নাকি শুধু দেশের বাইরে ঠেলে দেওয়া মিয়ানমারের উদ্দেশ্য ছিল, তা নিয়ে যে কেউ বিতর্ক করতেই পারে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দৃষ্টান্ত আছে, যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে সম্ভবত ওই জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার চেয়েও অন্য উদ্দেশ্য তাদের (মিয়ানমারের) ছিল।’

ওই তদন্তকারী বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ঢোকার আগমুহূর্তেও রোহিঙ্গাদের গণহারে হত্যার ঘটনাগুলো জেনে আমি আবেগতাড়িত হয়েছি। আমি শুনেছি, বাংলাদেশে আসার জন্য নদীর তীরে অপেক্ষা করার সময় শত শত বা হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে গুলি ও বোমায় মেরে ফেলা হয়েছে। আমি এও শুনেছি, সামরিক বাহিনীর (মিয়ানমারের) স্পিডবোটগুলো ইচ্ছা করেই শরণার্থীবোঝাই (রোহিঙ্গা) সরু নৌকাগুলোর মধ্যে ঢুকে যেত এবং আর তাতে নৌকাগুলো উল্টে গিয়ে আরোহীরা ডুবে মরত।’

‘এই দুটি উদাহরণেই মিয়ানমার মূলত রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর উদ্দেশ্য পূরণ করেছে। তবে সেটিই যথেষ্ট ছিল না। এর বদলে তারা রোহিঙ্গাদের মৃত্যু চেয়েছিল।’

এক হাজার ২৪ জন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে এসব পর্যবেক্ষণসহ ১৫ হাজার পৃষ্ঠারও বেশি তদন্ত প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরকে জমা দেয় পিআইএলপিজি। রোহিঙ্গাদের ওপর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ১৩ হাজারেরও বেশি ঘটনাসংবলিত আলাদা একটি ডাটা বেইসও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরকে দিয়েছে পিআইএলপিজি। সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর ‘গণহত্যা’ ও ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ সংঘটনের অসংখ্য আলামত থাকলেও ভূরাজনৈতিক স্বার্থে এবং মিয়ানমারে গণহত্যা ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার দায় এড়াতে যুক্তরাষ্ট্র এখনই ওই দুটি শব্দ (‘গণহত্যা’ ও ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’) বলা এড়িয়ে গেছে।

গত সোমবার রাতে কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর তার ওয়েবসাইটে ‘উত্তর রাখাইন রাজ্যে নৃশংসতার তথ্য লিপিবদ্ধকরণ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনের ২০ পৃষ্ঠার সারাংশ প্রকাশ করে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর নৃশংসতাকে ‘পরিকল্পিত ও সমন্বিত’ হিসেবে অভিহিত করেছে।

কালের কণ্ঠ’র সংগ্রহ করা পিআইএলপিজির একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তদন্তকারীরা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে গত বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বড় ধরনের নৃশংসতার শিকার হওয়ার তথ্য পেয়েছে। ‘স্ট্র্যাটেজিক গ্রাউন্ড অ্যাসাল্টের’ (কৌশলগত স্থল হামলা) তথ্য দিয়েছেন মংডু থেকে আসা ২০ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা নারী। তিনি বলেন, ‘তারা (মিয়ানমার বাহিনী) আরসা (কথিত রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী) খুঁজছিল। তারা বলছিল, খারাপ লোকদের খুঁজছে তারা। গ্রামে খারাপ লোকদের ব্যাপারে জানা থাকলে তাদের তথ্য দিতেও বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা সবার ওপর সব দিক দিয়ে হামলা করেছিল।’

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামগুলোতে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ‘কৌশলগত স্থল হামলা’ চালানোর সময় হেলিকপ্টার থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর গ্রেনেড ছোড়া হতো। খুব ভোরে বা শুক্রবার জুমার নামাজের সময় বড় হামলাগুলো চালানো হয়েছে। গাড়ি, জাহাজে করে বা হেঁটে শত শত সেনা এসে চারদিক ঘিরে ফেলে গ্রামের বাড়িগুলোতে আগুন দেওয়ার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের গুলি বা জবাই করে হত্যা করেছে। অনেক ক্ষেত্রে, মিয়ানমারের সেনারা রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে হামলা চালানোর আগে কাছাকাছি রাখাইন গ্রামগুলোতে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা আগে এসে অবস্থান নিয়েছিল।

তদন্তে রোহিঙ্গাদের ওপর অন্য নৃগোষ্ঠীর হামলার তথ্য মিলেছে। মংডু থেকে আসা ২৬ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা নারী বলেছেন, “সামরিক বাহিনীর সদস্যরা আমাদের এলাকা সম্পর্কে ভালো জানত না। তারা পাশের গ্রামগুলোর রাখাইনদের ‘গাইড’ হিসেবে নিয়ে আসত।”

রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের পেছনে জাতিগত, নৃগোষ্ঠীগত ও ধর্মীয় কারণও উঠে এসেছে তদন্তে। বুথিডং থেকে আসা ৩০ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা বলেছেন, ‘নদীর তীর থেকে আমাদের গ্রাম লক্ষ্য করে সামরিক বাহিনী ও পুলিশ গুলি ছোড়া শুরু করেছিল। তারা বলছিল, তোমরা বেঙ্গলি। তোমাদের বাংলাদেশে যেতে হবে।’

তদন্তে দেখা গেছে, মিয়ানমার বাহিনী অভিযান চালানোর সময় রোহিঙ্গাদের ‘জারজ সন্তান’ হিসেবে অভিহিত করার পাশাপাশি তাদের মা ও জাতিগত পরিচয় নিয়ে নিকৃষ্ট গালাগাল করত। রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্য করে মিয়ানমারের সেনাদের গালমন্দের কিছু ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে।

মংডু থেকে আসা ২৫ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা বলেছেন, মিয়ানমারের সেনারা শুধু রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা করেছে। একই গ্রামে অন্য নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা অক্ষত ছিল।

শিশুদের লক্ষ্য করে হামলার উদাহরণ দিতে গিয়ে প্রতিবেদনে মংডু থেকে আসা ৩০ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা নারীর বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘শিশুদের জবাই করে আগুনে ছুড়ে মারা হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে অনেক বেশি রোহিঙ্গা শিশু মারা গেছে।’

রোহিঙ্গা নেতা ও তাদের ধর্মীয় নিদর্শনগুলোতে হামলার তথ্য দিতে গিয়ে মংডু থেকে আসা ৪৯ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘আমি দেখেছি, কিছু ইসলামী আলেমকে এটি গ্রামে সমবেত করে সবার সামনে জবাই করে মারা হয়েছে। স্কুলে নবম শ্রেণিতে উঠেছিল এমন কিছু শিক্ষার্থীকেও জবাই করা হয়। তাদের জিহ্বা ও হাত কেটে আলাদা করা হয়।’

প্রতিবেদনে একজন তদন্তকারী বর্ণনা দিয়েছেন, ‘৩৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি তাঁর স্বজনদের নিহত হওয়ার কথা আমাকে জানানোর সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। গণধর্ষণ থেকে নিজের মেয়েকে বাঁচাতে তিনি গুরুতর আঘাত পান। তাঁর স্ত্রীকে চাপাতি দিয়ে ও মাকে রকেট লঞ্চার দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর ভাই, ভাগ্নে ও চাচা সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় পানিতে ডুবে মারা যান। তাঁর দাদা ছিলেন জ্যেষ্ঠ ইমাম। তাঁকে বেদম পিটিয়ে শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আরো ছয়জন ইমামকে লোহার পেরেক ও ভাঙা কাচের ওপর হাঁটানোর পর জবাই করা হয়।’

শত শত রোহিঙ্গা নারীকে টেনেহিঁচড়ে বা ট্রাকে করে সেনা ছাউনি বা অন্যত্র নিয়ে যাওয়া, ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের তথ্যও প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। অন্য নৃগোষ্ঠীর সদস্যরাও রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ধর্ষণে বাধা দিলে রোহিঙ্গা নারীদের পিটিয়ে মারা হতো বা অঙ্গচ্ছেদ করা হতো। ধর্ষণের শিকার হওয়া অনেক নারী আত্মহত্যা করেছে। বুথিডং থেকে আসা ২৫ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, ‘পথে প্রথম চেকপোস্টে তারা (মিয়ানমার বাহিনী) প্রথমে পুরো শরীর, স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে শুধু স্পর্শই নয়, চেপে পরীক্ষা করে। আমি কাঁদছিলাম। আরো অনেক নারী ও কন্যাশিশু কাঁদছিল। এভাবে একেক করে চারটি চেকপোস্ট পার হতে হয়। শেষ চেকপোস্টে তারা আমাদের পরনের কাপড়ও খুলে নেয়।’

অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ওপর হামলার বিবরণ দিতে গিয়ে মংডু থেকে আসা ২৪ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘হামলার সময় আমি যখন লুকাচ্ছিলাম তখন দেখতে পাই ছয়জন নারী মিলে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে সাহায্য করছেন। সেনারা ওই নারীদের প্রথমে গুলি ও পরে কেটেকুটে হত্যা করে। এরপর তিনটি গর্ত খুঁড়ে তাঁদের দেহের বিভিন্ন অংশ তাতে ছুড়ে ফেলে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাক্ষাৎকার দেওয়া এক হাজার ২৪ জন রোহিঙ্গার মধ্যে শুধু একজন বলেছেন যে তাঁর গ্রামে কোনো হত্যা হয়নি। তবে সব বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সবাই নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, গণহারে হত্যা এবং লোকজনকে বেঁধে শরীরে আগুন দেওয়ার তথ্য দিয়েছে। বিশেষ করে, প্রতিবন্ধী রোহিঙ্গাদের হাত-পা বেঁধে গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে মারার তথ্য রয়েছে প্রতিবেদনে।

Leave a Reply