শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) সৃষ্ট সংকট সমাধানে শুক্রবার দফায় দফায় বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। শুধু আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রায় ৩ ঘণ্টা বৈঠক করেন তিনি।
বিকালে সার্কিট হাউজে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। তারা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেছেন। কেন পদত্যাগ দাবি করেছেন-সেই কারণ তারা তুলে ধরেছেন।
আমরা এসব বিষয় আচার্যের কাছে তুলে ধরব। অপসারণ ও নতুন উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টি তিনি দেখবেন। সিলেট সার্কিট হাউজে বৈঠকের পর সন্ধ্যায় মন্ত্রী শাবি ক্যাম্পাসে যান।
সেখানে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্যে তিনি ক্যাম্পাস খোলা রেখে শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখতে সহযোগিতা কামনা করেন। এরপর তিনি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অংশ নিতে অবরুদ্ধ থাকা উপাচার্য প্রায় ২৬ দিন পর বাসভবনের বাইরে আসেন। উপাচার্যের সঙ্গে মন্ত্রীর বৈঠক শেষে রাত ৮টায় শাবি কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, শাবিতে যা ঘটেছে তা কারও জন্য কাম্য নয় বলে মন্ত্রী মন্তব্য করেছেন।
এজন্য উপাচার্যকে সব মহলের কাছে দুঃখ প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি (মন্ত্রী)। পাশাপাশি আচার্য সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যেতে বলেছেন।
শাবি ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগে সার্কিট হাউজে শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণে সিলেট এসেছি। বৈঠকে শিক্ষার্থীরা তাদের সব সমস্যা ও দাবি-দাওয়া তুলে ধরেছেন। তাদের দাবি-দাওয়াগুলো শিক্ষার মান, আবাসনের মান ইত্যাদি বিষয়ে।
তারা এসব নিয়ে বেশ চিন্তাভাবনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে তারা যেসব সমস্যার কথা বলেছে সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আমরা কথা বলব।
এসব দাবির অধিকাংশই পূরণ করব। কিছু কিছু উদ্যোগ ইতোমধ্যেই নিয়ে নিয়েছি। আমরা চাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসুক। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে শিগগিরই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরু হবে।
শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসে শাবি শিক্ষার্থীদের ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দল। দলে ছিলেন-মুহাইমিনুল বাশার রাজ, ইয়াসির সরকার, নাফিসা আনজুম, সাব্বির আহমেদ, আশিক হোসাইন মারুফ, সাবরিনা শাহরিন রশীদ, সুদীপ্ত ভাস্কর, শাহরিয়ার আবেদিন, আমেনা বেগম, মীর রানা ও জাহিদুল ইসলাম অপূর্ব।
আলোচনায় অংশ নেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, তারা উপাচার্যের পদত্যাগ ও তাকে সরিয়ে ক্লাস-পরীক্ষা চালু, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার, আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থীর মোবাইল অ্যাকাউন্ট চালু, পুলিশের গুলিতে আহত শিক্ষার্থী সজল কুন্ডকে এককালীন আর্থিক সহযোগিতা প্রদান ও তার জন্য ৯ম গ্রেডের চাকরি নিশ্চিতকরণ, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এবং অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হককে ইমেরিটাস প্রফেসর হিসাবে নিয়োগ প্রদান, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বাজেট বৃদ্ধি, পরীক্ষা পদ্ধতিতে কোডিং সিস্টেম কার্যকর করা, শিক্ষক নিয়োগে পিএইচডি এবং ডেমো ক্লাসের ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালুর দাবি উত্থাপন করেন। এসব দাবি পূরণ না হলে আলোচনা করে পরে করণীয় ঠিক করা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলন : শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা শেষে শুক্রবার রাত ৯টায় শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করেন। তারা জানান, আজ বিকাল ৪টা পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।
এ সময়ের মধ্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা শেষে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবেন। তারা বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে উপাচার্যের পদত্যাগ ছাড়া বাকি সব দাবির বিষয় ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।
উপাচার্যের পদত্যাগ বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রী আচার্যকে জানাবেন এবং তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন। শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, শিক্ষামন্ত্রী সব দাবি আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। শুধু উপাচার্যের বিষয়টি নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
শিক্ষার্থীরা নবনিযুক্ত প্রক্টর ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইশরাত ইবনে ইসমাইমের অপসারণ চেয়েছেন। এ দাবিতেও সম্মত হয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। আগামীতে নতুন প্রক্টরের নিয়োগে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেই নিয়োগ দেওয়া হবে বলে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন।
এর আগে দুপুরে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত শেষে সার্কিট হাউজে মধ্যাহ্নভোজ শেষে মন্ত্রী শাবি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন-শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনুবিভাগের সেক্রেটারিসহ তিন কর্মকর্তা।
সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে বিমানে সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি। এ সময় সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ সংশ্লিষ্টরা তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান।
১৩ জানুয়ারি শাবিপ্রবির বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্টের বিরুদ্ধে অসদাচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন কয়েকশ ছাত্রী।
পরে ওই আন্দোলনে যুক্ত হন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায়ে ১৬ জানুয়ারি উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করলে পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করার পাশাপাশি শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে।
এরপরই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এক দফা তথা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে রূপ নেয়। ওই দাবিতে ১৯ জানুয়ারি বেলা ৩টা থেকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আমরণ অনশনে বসেন ২৪ শিক্ষার্থী।
২৬ জানুয়ারি সকালে অনশনস্থলে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ইয়াসমিন হক। তাদের অনুরোধে শিক্ষার্থীরা অনশন থেকে সরে আসেন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় : সকালে সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন শিক্ষামন্ত্রী। সেখানে তিনি বলেন, খুব শিগগিরই দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে।
এছাড়া শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানে সরকার সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
মতবিনিময় সভায় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান, মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।