Friday, April 19

জেনে নিন, যে চার কারণে রোহিঙ্গাদের অপছন্দ করে মিয়ানমার!

১. বর্ণবাদী মানসিকতা:
মানবাধিকারকর্মীদের মতে, রোহিঙ্গাদের পছন্দ না করার মূল কারণ হলো জাতীয়তাবাদ উৎসারিত বর্ণবাদ।

২. ভিন্ন ধর্ম :
মানবাধিকারকর্মী ও বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের প্রেসিডেন্ট তুন খিন বলেন, ‘মিয়ানমারের উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সহজ লক্ষ্য রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গারা একটি ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী এবং এদের চেহারা ও ধর্ম—দুই-ই ভিন্ন। সুতরাং রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করাও সহজ।’

৩. ব্রিটিশ শাসকদের অধীনে সেনা হিসেবে নিয়োগ :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মুসলিমদের সেনা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল ব্রিটিশরা। অন্যদিকে বৌদ্ধ ও অন্যান্য সম্প্রদায় জাপানের পক্ষ নিয়েছিল। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, জাপানের সঙ্গে মিলে মিয়ানমার থেকে ঔপনিবেশিক শক্তিকে তাড়ানো। আর এই জায়গাতেই সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা ও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়।

৪. বাঙালি মনে করা :
মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াং বলছেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট হলো বাঙালি ইস্যু। তারা রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দাবি করছে, অথচ তারা কখনো মিয়ানমারের নৃগোষ্ঠী ছিল না।’ রোহিঙ্গারা নিজেদের জন্মভূমিতে জীবন কাটানোর আশাতে আছেন, তাঁরা চান সংখ্যালঘু হিসেবে স্বীকৃতি।

সূত্র: নিউজউইক ও এএফপি

রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলে সব কৌশল প্রয়োগ করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী

রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে জাতিগতভাবে নির্মূল করতে সব রকম কৌশল প্রয়োগ করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। গণহত্যা, গণধর্ষণ এমনকি পরিকল্পিতভাবে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। বহু লোককে সেনা সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছে। গুম হওয়া লোকদের পরিবারের সদস্যরা তাদের আর খুঁজে পায়নি। মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে এ ধরনের বহু রোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে যুবক ও যুবতীদের।

টেকনাফ ও উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে দেখা গেছে আশ্রয় নেয়া মানুষদের মধ্যে যুবক ও যুবতীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বাড়িতে আগুন দেয়ার আগে যুবক ও যুবতীদের আলাদাভাবে বাছাই করা হতো। এ ছাড়া শিক্ষক ও মসজিদের ইমামরা ছিলেন হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে বিশেষ টার্গেট। টেকনাফের শামলাপুরে আশ্রয় নেয়া মংডুর মেরুলা থেকে নদীপথে পালিয়ে আসা জোবায়ের নামে একজন রোহিঙ্গা জানান, তাদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়ার আগে বাড়িতে ঢুকে যুবক ও যুবতীদের আলাদা করে হত্যা করেছে। এ সময় তার বোন জামাইকে হত্যা করে সৈন্যরা। তিনি বলেন, এ সময় বিভিন্ন পরিবারের কমপক্ষে ৫০ জনকে হত্যা করা হয়। এরমধ্যে কিছু যুবতীকে সৈন্যরা ধরে নিয়ে গেছে। তারা কোথায় কিভাবে আছে তা তারা জানে না। গ্রামে আগুন দেয়ার আগে মিয়ানমারের সৈন্যরা তাদের বেশ কিছু নৌকায় আগুন ধরিয়ে দেয় যাতে পালিয়ে যেতে না পারে। এই গ্রামের আরেক বাসিন্দা জাফর আহমদ জানান, তার দুই ভাই মমতাজ উল্লাহ ও দিদার উল্লাহকে সৈন্যরা হত্যা করে। ভাগ্যক্রমে তিনি পালিয়ে আসতে পেরেছেন।

উখিয়ার তমব্রু সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে আসা মমতাজ নামে এক যুবক জানান, সাত দিন পায়ে হেঁটে তারা নানা ঘুরপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। তারা দলবদ্ধভাবে আসার সময় রাস্তায় একাধিক যুবক ও যুবতীর লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন। এরমধ্যে গলাকাটা লাশও ছিল। এই যুবক জানান, অনেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সৈন্য ও সৈন্যদের সহযোগী বৌদ্ধ তরুণদের আক্রমণের মুখে পড়েছেন। বালুখালীর এই শরণার্থী শিবিরে আমেনা নামে এক নারী আসার পথে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যিনি তার স্বামীকে খুঁজে পাচ্ছেন না। রোহিঙ্গা যুবকেরা যাতে আর কখনো মিয়ানমারে ফিরে যেতে না পারে সে কারণে তাদের হত্যা করা হয়েছে।

শরণার্থীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, গ্রামে আগুন দেয়ার পর এবং একাধিক হত্যাকাণ্ডের পর মানুষ দিগি¦দিক ছোটাছুটি করতে থাকে। ফলে অনেক পরিবারের সদস্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। থ্যাংখালী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আশ্রয় শিবিরে রহমত উল্লাহর পরিবারের প্রায় সব সদস্য আসতে পারলেও তার এক বোন আসতে পারেননি। ৬০ বছর বয়সী রহমত উল্লাহ জানান, পক্ষঘাতগ্রস্ত তার এক মামার ঘরে আগুন দেয়ার পর গড়িয়ে কোনো মতে বাড়ির উঠনে আসতে পারলেও এ সময় তাকে প্রথমে গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জবাই করা হয়। বোনের অপেক্ষায় থাকা রহমত উল্লাহ কথা বলার সময় বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার বোনকে আর খুঁজে পাবেন কি না তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছেন। তিনি জানান, তার মামার পরিবার মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামটিতে বেশ সম্পদশালী ছিলেন। ১৯৭৮ সালে যখন রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালানো হয় তখন তার নানা বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু এরপর তাদের পরিবারের আর কেউ এ দেশে আসেননি বলে জানান। তারা সেখানে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং ভালো ছিলেন। রহমত উল্লাহ বলেন, এভাবে ধর্মের কারণে নিজ দেশের ভিটেমাটি ফেলে আসতে হবে তা কখনো আমাদের মনে হয়নি।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, তারা যাতে আর কখনো তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে না পারেন এ কারণে গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। উখিয়ার তমব্রু সীমান্ত থেকে দেখা গেছে ওপারের গ্রামগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার কারণে বড় গাছগুলো জ্বলে বিবর্ণ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে দূরের এলাকা বুচিডং বা রথেডং থেকে যারা এক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় হেঁটে পাহাড় জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন; এ ধরনের পরিবারের অনেক শিশু না খেয়ে রাস্তায় মারা গেছে। আবার খাবার না পেয়ে লতাপাতা খেয়ে থেকেছেন। তমব্রু সীমান্তে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির একজন সদস্য জানান, ধানক্ষেতে শিশুর জন্মের মতো অমানবিক দৃশ্য তাদের দেখতে হয়েছে।

বেশির ভাগ রোহিঙ্গা পরিবারের কোনো কোনো সদস্য হত্যা, গুম বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে এক ধরনের মানসিক অসুস্থতার মধ্যে রয়েছেন। বিশেষ করে শিশুদের ওপর এর প্রভাব পড়েছে মারাত্মক। অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যাবেন কি না এমন প্রশ্ন করলে সেখানে গেলে তাদের মেরে ফেলা হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন।

Leave a Reply