Thursday, April 18

‘এক পৃথুলার আত্মত্যাগ জন্ম দিক আরো শত শত পৃথুলার’

কাঠমান্ডুতে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ২৬ জন বাংলাদেশির মধ্যে সবচেয়ে আলোচনা হচ্ছে কো-পাইলট পৃথুলা রশীদকে ঘিরে৷ মৃত্যুর পরও কিছু মানুষ তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন৷ অথচ এই নারীই বাঁচিয়েছেন ১০টি প্রাণ৷
১২ই মার্চ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার বিমান বিধ্বস্তের পর যখন একে একে নিহতদের খবর জানা গেল৷ তখন বিমানের পাইলট এবং কো পাইলট কে ছিলেন সে ছবিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ঘুরছিল৷ কো-পাইলট ছিলেন পৃথুলা রশীদ, যিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী৷ নারী হওয়ার অপরাধে মৃত্যুর পরও রেহাই পাননি এই নারী৷ অনেকেই তাঁর যোগ্যতা আর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেন৷ অথচ পরে দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া কয়েকজন জানান, এই পৃথুলাই ১০ জনের জীবন বাঁচিয়েছেন৷

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই ঘটনায় নিহতদের প্রতি শোক এবং পরিবার ও স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন অনেকেই৷ তবে পৃথুলাকে নিয়েও লিখেছেন তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন৷
সাদিয়া নাসরিন ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘‘পৃথুলার অপরাধ কম নয়৷ এই পুরুষ শাসিত সমাজে পৃথুলা উর্ধাকাশ ভেদ করে আরো আরো আরো উপরে উঠেছিল৷ অত উপরে উঠেছিল বলেই আমরা অনেকেই যা পারি না, আমরা অনেকেই যা করি না পৃথুলা তাই পেরেছিল, তাই করেছিল৷ নিজে মরতে মরতে দশজন ভিনদেশির জীবনকে নিরাপদে তাঁদের স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে গেল৷ তারপর এই বীরকন্যা চুপচাপ মৃত্যুকে গ্রহণ করলো৷ নেপালের গণমাধ্যম এই বীরকন্যাকে ‘ডটার অফ বাংলাদেশ’ বলে উল্লেখ করেছে৷ আর আমরা এই বাংলাদেশের মানুষরা (পড়ুন পুরুষ) এই মেয়েটিকে বিমান দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করে মিড়িয়া ট্রায়াল শুরু করেছে৷”
মাশরুফ হোসেইন লিখেছেন, ‘‘মরার আগে এই মেয়েটা যত জনকে পেরেছে বাঁচিয়ে গেছে৷ মরেও এর শান্তি হয় নাই, পুরুষতান্ত্রিক তেলাপোকাগুলো শোরগোল তুলেছে যে মেয়েদের দিয়ে প্লেন চালানো হয় না৷ এই তেলাপোকাগুলো আরো দশবার জন্মালেও নিজ যোগ্যতায় প্লেনের ককপিট দেখবার যোগ্যতা অর্জন করবে না৷ পাইলটের অদক্ষতায় যদি দুর্ঘটনা হয়, সেক্ষেত্রেও তার লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার কারো নেই৷ আলাদা করে পৃথুলার কথা লিখছি, কারণ তাঁকে মৃত্যুর পরেও গালি শুনতে হচ্ছে স্রেফ নারী হওয়ার কারণে৷ এক পৃথুলার আত্মত্যাগ জন্ম দিক আরো শত শত পৃথুলার!”
কাজী সাবির লিখেছেন, ‘‘এরপর থেকে প্লেনে ওঠার আগে জেনে নিবেন যে পাইলট নারী কিনা, দুর্ঘটনা হলে তার মমতায় আপনার জীবনটা বেঁচেও যেতে পারে!”

তৃষিয়া নাশতারান তুলে ধরেছেন আমাদের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্যের চরম দিকটা৷ লিখেছেন, ‘‘প্লেনটা চালাচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান৷ সেটা নিশ্চিত হওয়ার পরে পুরুষের চালনশৈলী বিষয়ক কোনো সমালোচনা আমার চোখে পড়েনি৷ বরং আবিদ সুলতানের ক্যারিয়ারের বৃত্তান্ত লিখে, তিনি কত ব্রাইট অফিসার সেটা লিখে খবর এসেছে৷ তিনি একটানা তিনটা ফ্লাইটে সেদিন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ছিলেন সেটা জেনেছি৷ কী কারণে পাইলট ওই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ হচ্ছে এবং সেটাই স্বাভাবিক৷ আবিদ সুলতানের জায়গায় পৃথুলা রশিদকে রেখে ভাবুন একবার৷ একজন পাইলট শুধুই একজন পাইলট৷ তিনি নারী বা পুরুষ হিসেবে আলাদা সম্মান কিংবা সমালোচনা কেন পাবেন? কেউ সংবেদনশীল হতে না পারলে অন্তত চুপ থাকতে তো পারেন৷”
শোক প্রকাশ করে জাহাঙ্গীর বেগ লিখেছেন, ‘‘শোক জানানোর ভাষা আমার জানা নেই৷ সকলের পরিবার পরিজনের প্রতি জানাই গভীর শোক৷ আল্লাহ তাঁদের পরিবারবর্গকে এই শোক সইবার তৌফিক দান করুন৷ আমিন৷”
রোমানা আফরোজ ন্যান্সি লিখেছেন, ‘‘‘রং দে বসন্তি’ মুভিটার কথা মনে আছে তো? পুরোনো জং ধরা যন্ত্রপাতি….অব্যবহারযোগ্য বিমানের জন্য দেশের মেধাবী প্রাণগুলো এভাবে চলে যায়৷ কিন্তু বাস্তব আর মুভি তো এক না৷ বাস্তবে আমরা দু’দিন পরেই এই দুর্ঘটনা ভুলে যাবো৷ যেহেতু মেধাবী মুখ আবিদ এবং পৃথুলা আমাদের কেউ নয়, সেহেতু নতুন কোনো ইস্যু পেলেই আমরা ভুলে যাবো তাঁদের৷”
লুসি তৃপ্তি গোমেজ লিখেছেন, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রিমুকে নিয়ে, যিনি সপরিবারে এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন৷ লুসি একাই নন, এই দম্পতিকে নিয়ে লিখেছেন অনেকেই৷ তাদের সহকর্মী আর সহপাঠীদের হাহাকারে ভরে উঠেছে ফেসবুকের পাতা৷ লুসি লিখেছেন, ‘‘রিমু ভাই, ভাবী, অনিরুদ্ধ তোমরা রবে নীরবে হৃদয়ে স্মরণে৷ রিমু ভাই শুধু রিতু আপুর ভাই ছিল না, আমারও বড় ভাই ছিল৷ যতবারই দেখা হয়েছে দেখা হবার রেশ থেকে গেছে বহুক্ষণ৷ সুন্দর কথা আর কাজের অনুপ্রেরণা থাকত বাকি সময় জুড়ে৷ রিমু ভাই, ভাবী আর অনিরুদ্ধ তিনজনের ছবি দেখে মনে হচ্ছিল কী ভাগ্যবান ওরা তিনজন সুন্দর মানুষ একসাথে ছিল জীবনে-মরণে৷ দুর্ভাগ্য আমাদের তোমাদের হারিয়েছি আর দেখা হবে না কথা হবে না আর কোনদিন৷ খালাম্মার মুখটা শুধু মনে ভাসছে, হে ঈশ্বর শক্তি দাও, যে শোক দিয়েছ তাঁদের সে হইবার শক্তি দাও৷ ৫০ জন মানুষ গেছে, রেখে গেছে অসংখ্য ব্যথা ভরা মন৷ তাঁদের শান্তি হোক৷”

জিল্লুর রহমান লিখেছেন, ‘‘কাঠমান্ডু ঘুরলে অনেক জায়গায় বড় বড় বিলবোর্ড দেখা যায়, সেখানে উচ্চশিক্ষার্থে বাংলাদেশে পড়ার বিজ্ঞাপন৷ আমি এই ১৩ জন শিক্ষার্থীর পরিবারের গল্প জানি না৷ তবে তাদের সংগ্রামের ইতিহাস থেকে বলতে পারি৷ মৃত মানুষদের কোনো দেশ থাকে না৷ দেশ একটাই যেখান থেকে ফেরা যায় না৷ শুধু থাকে তাদেরকে ঘিরে বেঁচে থাকা অনেক মানুষের কান্না৷”

Leave a Reply