
কর্মকর্তাদের টেবিলে বসে গ্রাহকের বাড়িতে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্নকরণ, অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রমাণাদিসহ ও মামলা দায়েরের ভুয়া অভিযান পরিচালনা করার তথ্য পাওয়া গেছে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে।
সেই ভুয়া অভিযানের দু’কর্মকর্তা কৃষক এ.বি.এম ঈশারুল্লাহর নামে ডাবল মামলা করেছেন। এক মামলায় জামিনে এসে আবারও বিদ্যুৎ বিভাগের ভুলে আরেক মামলায় জেল খাটছেন এ কৃষক। টিউমারের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে ছটপট করলেও অর্থাভাবে করতে পারেনি অপারেশন। তিনি উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের শ্রীধরপুর গ্রামের মরহুম মাওলানা আবুল বাশারের পুত্র।
তার স্ত্রী জাহানারা খাতুন জানান, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি করোনা প্রতিরোধের টিকা দেওয়ার জন্য গৌরীপুরে যাওয়ার পর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে প্রেরণ করেছে। ঈশ্বরগঞ্জ আবাসিক প্রকৌশল দপ্তরের অধিনে বিদ্যুৎ হিসাব নং ৫৫৫৬/বি, গ্রাহক নং ৭৬১০৬৮৯০, বই নং কে ৫৬, ওয়াক অর্ডার ২০৮৫নং সেচ গ্রাহক ছিলো আমার স্বামী।
তিনি জানান, তার বাড়িতে কোনো কর্মকর্তা আসেনি, কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি, অবৈধ বিদ্যুৎও ব্যবহার করেনি অথচ স্বামীর বিরুদ্ধে ১০৮৮/১৭ নং ও ৩০৯/১৮নং ২টি মামলা করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, তার স্বামীর শরীরে টিউমারের থাকায় অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। ১০৮৮নং মামলায় ২০১৮সালে গ্রেফতার হন। তখন এলাকাবাসী ও আত্মীয়স্বজন ২০১৮সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ৪০হাজার টাকা বিদ্যুৎ অফিসে জমা দিয়ে জামিনে নিয়ে আসেন। যেহেতু আমার স্বামী বিদ্যুৎ ব্যবহার করেনি, তাই আদালতের বিচারক বিদ্যুৎ বিল সংক্রান্তে তদন্ত দেন। সেই তদন্ত রিপোর্ট বিদ্যুৎ বিভাগ আজও দেয়নি। তবে ওই বছরের ১৭ অক্টোবর ৩০৯/১৮নং আরেকটি মামলা করে। এ মামলায় আমার স্বামী বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন!
জাহানারা খাতুন আরো বলেন, আমার স্বামী জেলে, বিদ্যুৎ লাইন, মিটার ও তার সবকিছু খুলে নিয়ে গেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তারপরও ২০২১ সালের মার্চ মাসে বিল দেওয়া হয়েছে ১লাখ ৮১হাজার ৯৯টাকা।
গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন গৌরীপুর থানার অফিসার ইনচার্জ খান আব্দুল হালিম সিদ্দিকী।
তিনি জানান, বিদ্যুৎ সংক্রান্ত মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় তাকে ২৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
এক ঘটনায় ২টি মামলার ১নং স্বাক্ষী ও তৎকালীন সময়ের ঈশ্বরগঞ্জের আবাসিক প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার নিরঞ্জুন কুন্ডু এ প্রতিনিধিকে বলেন, এক গ্রাহকের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা! সেই সময় কেন হয়েছিলো, এই মুর্হুতে কিছু বলতে পারছি না।
বিদ্যুৎ গ্রাহককে অহেতুক হয়রানির তীব্র-নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন গৌরীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি শফিকুল ইসলাম মিন্টু।
তিনি জানান, কর্তব্যে অবহেলা ও কৃষক জেলে এ ঘটনার সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন গৌরীপুর শাখার সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ বলেন, ১০৮৮/১৭নং মামলায় এবিএম ঈশারুল্লাহকে বিজ্ঞ বিচারক জামিন দেন এবং অযৌক্তিক বিল করায় বিদ্যুৎ বিভাগকে তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই তদন্ত প্রতিবেদন না দিয়ে, তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করা দুঃখজনক ঘটনা।
ঈশ্বরগঞ্জ আবাসিক প্রকৌশলী বিদ্যুৎ (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ আল মোমেন জানান, এই গ্রাহক ২০১৯সনে এসেছিলো, কোর্টের তদন্তের নির্দেশ নিয়ে আসতে বলেছিলাম, এরপরে আর আসেননি। দু’টি মামলার ঘটনা আগের কর্মকর্তাদের সময়ের তাই এ প্রসঙ্গে আমি কিছু বলতে পারছি না।
এদিকে ঈশারুল্লাহর ভাই ওমর ফারুক জানান, ঈশ্বরগঞ্জ আবাসিক প্রকৌশলীর দপ্তরের আওতাধীন একজন সেচ গ্রাহক ছিলেন তার ছোট ভাই ঈশারুল্লাহ। ২০১২সালে সেচ চালানোর পর আর সেচ চালায়নি। ওই বছরের বিদ্যুৎ বিল ৯হাজার ১৭৩টাকা পরিশোধও করেনি। এ বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের জন্য ২০১৩সালের ২৩নভেম্বর পত্র প্রেরণ করেন। এ পত্রের পরেও আর্থিক ও শারীরিক দুরবস্থার জন্য এ বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারেনি ঈশারুল্লাহ।
‘সেচ গ্রাহকের বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধসহ ডিজিটাল মিটার স্থাপন’ সংক্রান্ত পত্র প্রদান করেন। এ পত্রে ১০/১২/২০১৪ তারিখের মধ্যে বিল (ভৌতিক বিল) ৪৩,৭৫৪টাকা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়। আমার ভাইয়ের শারীরিক অসুস্থ হয়ে পড়ায় এবং সেচ কার্যক্রম সচল না থাকায় বিদ্যুৎ বিল দেয়নি। ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ মিটার খুলে নিয়ে যায়। মিটার নেই, বিদ্যুৎ নেই, নেই সেচ কার্যক্রম তারপরেও ভৌতিক বিল থেমে থাকেনি!
এদিকে মামলা দায়ের-বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করণের নিমিত্তে বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল আদালতে মামলা দায়েরের পরেও ভৌতিক বিলকরণ থামেনি!
২০১৭সালের এপ্রিলে ৩৮৫০টাকা, মে মাসে ৪২৩৯টাকাসহ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১লাখ ২৮হাজার ৮১২টাকা বকেয়া বিদ্যুৎ বিল দেয়া হয় এ কৃষককে। এ বকেয়া টাকা উত্তোলনের জন্য ময়মনসিংহ বিউবোর সহকারী প্রকৌশলী মো. আজিজুর রহমান বাদী হয়ে বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবারও মামলা করেন।
এ মামলায় আবারও উল্লেখ করা হয় ৮/২/২০১৮ তারিখে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে অভিযানে এই বাদী অভিযান চালিয়ে দেখতে পান ঈশারুল্লাহ অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে, যার রাজস্ব ক্ষতি হিসাবে ১২১০টাকা ধার্য্য করা হয়।
অপরদিকে প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় মামলা, বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্নকরণের কথিত গল্পের পরেও ভৌতিক মিটারের বিল বাড়তেই থাকে। ২০১৮সালের জানুয়ারি মাসে ৪০৩০টাকা, ফেব্রুয়ারি মাসে ২৩১টাকা, ২০২০সালের অক্টোবরে ২৩হাজার ২৬৩টাকা, নভেম্বরে ৪হাজার ২২৭টাকাসহ ২০২১সনের মার্চ মাস পর্যন্ত ১লাখ ৮১হাজার ৯৯টাকার বিদ্যুৎ বিল প্রদান করা হয়েছে জেলে থাকা এ কৃষককে।
তবে অনুসন্ধানেই পরেই বিলের মিটার কমতে শুরু করেছে! গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিলের ২০২১সনের মার্চ মাস পর্যন্ত ১লাখ ৮১হাজার ৯৯টাকা উল্লেখ রয়েছে।
তবে ঈশ্বরগঞ্জের আবাসিক প্রকৌশল বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. জাকারিয়া কবীর বুধবার এ প্রতিনিধিকে জানান, এবিএম ঈশারুল্লাহ এর এখন বিদ্যুৎ বিল ৯৪হাজার ৩২৯টাকা!
