
টাইটানিক জাহাজ: ইতিহাস ও ডুবে যাওয়ার রহস্য
(History & Mystery of RMS Titanic)
টাইটানিক শুধু একটি জাহাজের নামই নয়, এক আফসোসের নাম আমাদের কাছে। যা হতে পারত মানুষের হাতে বানানো শ্রেষ্ঠত্বের বিরল উদাহরন, যাকে বলা হয়েছিল কখনো ডুবে যাবে না – নিজের প্রথম যাত্রাতেই দুঃখজনক সলীল সমাধি জুটে এর ভাগ্যে।
গ্রিক পুরানের শক্তিশালী দেবতা টাইটানের নামানুসারে এই জাহাজের নাম রাখা হয়েছিল ‘টাইটানিক’। তবে এটি আসলে ছিল জাহাজটির সংক্ষিপ্ত নাম।পুরো জাহাজটির নাম ছিল ‘রয়্যাল মেল স্টিমার টাইটানিক’ সংক্ষেপে আরএমএস টাইটানিক (RMS Titanic)। টাইটানিকের নির্মাণকাজ শুরু করা হয় ১৯০৭ সালে। পাঁচ বছর পর ১৯১২ সালে জাহাজটির কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। হল্যান্ডের ‘হোয়াইট স্টার লাইন’ কোম্পানি জাহাজটি নির্মাণ করে ব্রিটেনের বেলফাস্টের হারল্যান্ড & ওলফ্ শিপইয়ার্ডে।
৬০ হাজার টন ওজন এবং ২৭৫ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট জাহাজটি নির্মাণ করতে সে সময় খরচ হয়েছিল ৭৫ লাখ মার্কিন ডলার। সেসময়, এটিই ছিল সবচেয়ে বিলাসবহুল প্রমোদতরী। জন পীয়ারপন্ট মরগান নামক একজন আমেরিকান ধনকুব আর ইন্টারন্যাশনাল মার্কেন্টাইল মেরিন কোং যৌথভাবে এর নির্মাণে অর্থায়ন করে। এত দীর্ঘ টাইটানিক ছিল তিনটি ফুটবল মাঠের সমান লম্বা!
টাইটানিক (Titanic) এতে ভ্রমণের ব্যয়বহুলতা এবং সৌন্দর্য আর চাকচিক্যের দিক থেকে তখনকার সকল জাহাজকেই ছাড়িয়ে গিয়েছিল। টাইটানিকের ভেতরে ছিল সুইমিং পুল, জিমনেসিয়াম, স্কোয়াস কোর্ট, তুর্কিস বাথ, ব্যয়বহুল ক্যাফে এবং ফার্স্ট ক্লাস আর সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রীদের জন্য ছিল আলাদা বিশাল লাইব্রেরী। তখনকার সময়ের সকল আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটেছিল এ জাহাজটিতে। এ জাহাজের ফার্স্ট ক্লাসের জন্য তিনটি, সেকেন্ড ক্লাসের জন্য একটি সহ মোট চারটি লিফটের ছিল। ফার্স্টক্লাস শ্রেণীতে চড়তে সবচেয় ব্যয়বহুল প্যাকেজটিতে আটলান্টিক একবার অতিক্রম করতেই ব্যয় ধরা হয়েছিল তখনকার সময়ে প্রায় ৪,৩৫০ ডলার, যা আজকের হিসেবে প্রায় ৯৫,৮৬০ ডলার এর মত!
১৫ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন তখনকার পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইংল্যান্ডের রাজকীয় কমান্ডার এডওয়ার্ড জন স্মিথের নেতৃত্বে টাইটানিক ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল ইংল্যান্ডের সাইদাম্পটন নৌঘাঁটি থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে তার প্রথম প্রমোদযাত্রা শুরু করেছিল। ১৪ই এপ্রিল রাত্রে নিস্তব্দ সমুদ্রের তাপমাত্রা শূণ্য ডিগ্রীরও নিচে নেমে যায়। আকাশ পরিষ্কার থাকলেও সে রাতে চাঁদ দেখা যাচ্ছিল না। সামনে বিশাল ভাসমান বরফখন্ড আছে এমন সংকেত পেয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন জাহাজের গতি সামান্য দক্ষিন দিকে ফিরিয়ে নেন। সেদিন দুপুর ১:৪৫ এর দিকে আমেরিকা নামের একটি জাহাজ রেডিওর মাধ্যমে টাইটানিকের সামনে বড় একটি আইসবার্গ আছে বলে সর্তক করে দেয়।
কিন্তু টাইটানিকের রেডিও যোগাযোগের দায়িত্বে থাকা জ্যাক পিলিপস্ এবং হ্যারল্ড ব্রীজ এ সতর্কবার্তাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে টাইটানিকের মূল্য নিয়ন্ত্রনকেন্দ্রে এ তথ্য প্রেরন করেননি। একইদিনে মেসাবা নামের আরেকটি জাহাজ টাইটানিকের পথে অবস্থিত ঐ বিশাল আইসবার্গটির ব্যাপারে আবারো সতর্ক করে। কিন্তু এবারো রেডিও অপারেটরদের কারনে টাইটানিকের মূল যোগাযোগ কেন্দ্রে পৌছায়নি এই বার্তা।
রাত ১১:৪০ এর সময় টাইটানিকের নাবিকরা টাইটানিকের সামনে সেই আইসবার্গটি দেখতে পায় কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফার্স্ট অফিসার মুর্ড আকস্মিকভাবে বামে মোড় নেওয়ার নির্দেশ দেন এবং জাহাজটিকে সম্পূর্ণ উল্টাদিকে চালনা করতে অথবা বন্ধ করে দিতে বলেন। কিন্তু টাইটানিককে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি, ডানদিকে আইসবার্গের সাথে প্রচন্ড ঘষা খেয়ে চলতে থাকে। একসময় টাইটানিকের প্রায় ৯০ মিটার অংশ জুড়ে চিড় দেখা দেয়।
জাহাজটি সর্বোচ্চ চারটি পানিপূর্ণ কম্পার্টমেন্ট নিয়ে ভেসে থাকতে পারতো কিন্তু দুর্ভাগ্যে সে রাতে পানিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল ৫ টি কম্পার্টমেন্টই। পানিপূর্ণ কম্পার্টমেন্টগুলোর ওজনের কারনেই জাহাজটির সামনের দিক আস্তে আস্তে পানিতে ডুবতে থাকে। এ আকস্মিকতায় ক্যাপ্টেন স্মিথ মূল নিয়ন্ত্রন কেন্দ্রে আসেন এবং জাহাজটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করবার আদেশ করেন। ১৫ তারিখ মধ্যরাত্রির দিকে টাইটানিক থেকে লাইফবোটগুলো নামানো শুরু হয়। সাহায্য চেয়ে টাইটানিক বিভিন্ন দিকে জরুরী বিপদ সংকেতও পাঠিয়েছিল। যেসকল জাহাজ সাড়া দিয়েছিল তার অন্যতম হল মাউন্ট ট্যাম্পল, ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং টাইটানিকেরই একরকম সহোদর ওলেম্পিক। রাত ০২:০৫টা’র দিকে জাহাজের সম্পূর্ণ মাথাই প্রায় পানির কাছাকাছি নেমে আসে।
০২:১০ এর দিকে প্রপেলারকে উপরে তুলে দিয়ে জাহাজের পেছনের দিক উপরের দিকে উঠে যায়। কিছুক্ষন পরে ওজনের কারনে টাইটানিকের পেছনের অংশ সামনের অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং জাহাজের সামনের দিক পুরোপুরি পানির নিচে চলে যায়। বায়ুজনিত কারনে পেছনের অংশটি কিছুক্ষন ভেসে থাকার পর রাত ০২:২০ এর দিকে ধীরে ধীরে সমূদ্রের অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। একই সাথে টাইটানিক (Titanic) হয়ে যায় ইতিহাসের পাতায় একটি আফসোসের নাম, চিরদিনের জন্য।
টাইটানিকের অন্যতম আশ্চর্যজনক ব্যপার ছিল এর বাদক দল। ওয়ালিস হার্টলির নেতৃত্বে এ দলটি প্রথমদিকে ফার্স্টক্লাস লাউঞ্জে, পরবর্তিতে ডেকের সামনে চলে আসে এবং মানুষকে ভয়হীন, উদ্যমী ও সাহসী করে তুলতে জাহাজ ডুবার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত বাজনা বাজিয়ে গিয়েছিল। অনেকেরই ধারনা করেন টাইটানিক জাহাজে কোন অভিশাপ ছিল, কারন হিসেবে তারা দেখিয়েছিলেন এর নম্বর 390904। আয়নায় যার প্রতিবিম্বের পাশ পরিবর্তন করলে হয় NO POPE।
টাইটানিক (Titanic) এর করুন পরিনিতি সারা বিশ্বে এতটাই পরিচিতি পেয়েছিল যে, এর উপর ভিত্তি করে অসংখ্য সাহিত্য, নাটক, প্রতিবেদন চিত্র এবং ছায়াছবি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে বক্স অফিসে নাম করে নেয় জ্যামস ক্যামেরনের টাইটানিক মুভিটি। ঝুকি থাকা সত্ত্বেও তিনি ২০০ মিলিয়নেরও বেশী টাকা ব্যয় করে টাইটানিক ছবিটি নির্মান করেন। অনেক চলচিত্র সমালোচকই বলেছিল ছবিটি এত টাকা ব্যবসা করে তুলে আনতে পারবে না। ছবিটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে সারা বিশ্বথেকে প্রায় ১.৮৩৫ বিলিয়ন ডলার আয় করে এবং আগের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে দিয়ে ১১টি অস্কারসহ আরো অন্যান্য ৭৬টি পুরস্কার জিতে নেয় পরের বছরেই।
এত বছর পরেও টাইটানিক নিয়ে মানুষের আগ্রহ যেন মনে করিয়ে দেয়, টাইটানিক আসলে ডোবেন-অন্তত মানুষের হৃদয়ে সে ভেসে চলছে অবিরত।