
ইউক্রেনে রাশিয়ার রকেট হামলায় বাংলাদেশি ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজে নিহত ক্যাপ্টেন মো. হাদিসুর রহমান আরিফের (২৯) গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। মায়ের আহাজারি যেন থামছেই না।
‘আমাদের কপাল পুড়েছে, সংসার চলবে কীভাবে’- এভাবে বলছেন আর আহাজারি করছেন ক্যাপ্টেন মো. হাদিসুর রহমান আরিফের মা।
নিহত হাদিসুর রহমান আরিফ বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আ. রাজ্জাক হোসেন ও আমেনা বেগমের বড় ছেলে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা-বাবা। ছেলের লাশ দেশে আনার জন্য সরকারের কাছে আকুতি জানিয়েছেন।
জানা যায়, নিহত হাদিসুর রহমান বাংলাদেশি ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ নামের ওই জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
গত বুধবার স্থানীয় সময় ভোর ৫টা ১০ মিনিটে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের তিনি হামলার শিকার হন।
স্বজনরা জানান, ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজটিতে সাত বছর ধরে চাকরি করেন হাদিসুর। জাহাজ থেকে হাদিসের এক বন্ধু ফোন করে জানান, বন্দরের জলসীমায় ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে আটকে আছে তাদের জাহাজ। ইউক্রেনের সময় বুধবার ৫টা ১০ মিনিটের দিকে তাদের জাহাজে হামলা হয়েছে। জাহাজে নিহত হাদিসুর রহমানসহ বাংলাদেশের মোট ২৯ জন নাবিক ছিলেন। এর মধ্যে হাদিসুর জাহাজের সামনে বাইরে অবস্থান করায় রকেট হামলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নিহত হন।
এর আগে বাংলাদেশি জাহাজটিতে হামলার খবর গণমাধ্যমের ফেসবুক মেসেঞ্জারে নিশ্চিত করেন জাহাজটিতে থাকা একজন নাবিক। তিনি বলেন, ইউক্রেনের সময় ৫টা ১০ মিনিটের দিকে আমাদের জাহাজে বিমান হামলা হয়েছে। আগুন নেভানোর চেষ্টা করছি। অন্য আরেক নাবিক লিখেছেন, ‘বোমা পড়ছে’।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজটিতে সাত বছর যাবত চাকরি করছিলেন আরিফ। ইউক্রেনের সময় বুধবার বিকাল ৫টা ১০ মিনিটের দিকে তাদের জাহাজে হামলা হয়েছে। জাহাজে আরিফসহ বাংলাদেশের ২৯ জন নাবিক ছিলেন। বাকিরা সুস্থ আছেন।
নিহত হাদিসের ছোট ভাই তরিকুল ইসলাম তারেক বলেন, আমরা জাহাজে থাকা ভাইয়ের সহকর্মীদের কাছেই মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়েছি। এরপর থেকেই আমার বাবা বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছেন, মা বেহুঁশ।
তিনি আরও বলেন, বুধবার সকালেও ভাই আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেই সময়ে ফোনে বলেন- ‘ভাই আমাদের আর ভাঙ্গা ঘরে থাকতে হবে না। বাড়িতে এসেই যেভাবে হোক ঘরের কাজ ধরব। ফোনালাপে ইউক্রেনে বোমা, গুলির শব্দ ও যুদ্ধের অবস্থা নিয়েও কথা হয়। ভীতিকর পরিস্থিতি নিয়ে আরিফ শঙ্কিত ছিল বলেও জানান তিনি। বাড়ি ফেরার তাড়া অনুভব হয়েছিল আরিফের কথায়। বাড়ি ফিরে কী কী কাজ করবে, ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তার একটি আলোচনাও করেন তিনি।
নিহত ক্যাপ্টেন হাদিসুরের মা আমেনা বলেন, এক নজরের জন্য হলেও আমার সন্তানের লাশটা দেখতে চাই। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ যাতে আমার সন্তানের লাশ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এসব বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
বেতাগী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাকছুদুর রহমান ফোরকান তিনি বলেন, আমি শুধু উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবেই বলছি না। নিহত ক্যাপ্টেন হাদিসুর রহমান আমার স্বজন, আমার ব্লাড, সে আমার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। ছোটবেলা থেকেই সে মেধাবী ও ভালো ছাত্র ছিল। মেরিন একাডেমি থেকে ৪৭তম ব্যাচের ২০১৩ সালে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়। বুধবার রাত ১২টার দিকে টিভির ব্রেকিং নিউজের মাধ্যমে জানতে পারি ইউক্রেনে রাশিয়ার রকেট বোমা হামলায় হাদিসুর রহমান নামের এক বাংলাদেশি নাবিক নিহত হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাকে নৌপরিবহনমন্ত্রী ফোন দিয়ে আশ্বস্ত করেছেন- নিহত নাবিক হারিসুর রহমানের লাশ পাওয়া গেছে। বর্তমানে লাশ ওই জাহাজের ফ্রিজে রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করা হয়েছে। খুব শিগগিরই লাশ পরিবারকে এনে দেওয়া হবে।
বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান তিনি বলেন, এসব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখভাল করবে। আমাদের কিছু করার নেই। এটা তাদের দায়িত্ব।
প্রসঙ্গত, সিরামিকের কাঁচামাল ‘ক্লে’ পরিবহনের জন্য জাহাজটি তুরস্ক থেকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের জলসীমায় পৌঁছায়। তবে যুদ্ধাবস্থা এড়াতে জাহাজটিকে সেখানে পৌঁছানোর পরই পণ্য বোঝাই না করে দ্রুত ফেরত আসার জন্য নির্দেশনা দেন শিপিং কর্পোরেশন কর্মকর্তারা। শেষ মুহূর্তে বন্দরের পাইলট না পাওয়ায় ইউক্রেনের জলসীমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বাংলাদেশের এই জাহাজ।
