Tuesday, April 23

ভালোবাসা দিবসে , টাকার জন্য কি না করলো। ছিঃ ছিঃ

আমার দু হাতের মাঝে চৈতির কোমরটা আটকে আছে, তার নাকের সাথে নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি দুজন। এতটা কাছে এর আগে কখনো আসা হয়নি দুজনার, আজ কোথা থেকে যে কি হয়ে এমন হল সেটা ভুলে গিয়েছি ইতোমধ্যে। দুজনের নিশ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে, গরম নিশ্বাসে পোড়া বাড়িটারও যেন তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে, শুকনো পাতা সরে যাওয়ার আওয়াজ শুনে দুজন দুজনে ছাড়িয়ে নিলাম। চৈতি দৌড়ে পালিয়ে গেল, আমি বাইরে যেয়ে দেখি দুটো নেঙটি ইঁদুর ছোটাছুটি করছে। ভাগ্যিস ভগবান ইঁদুর দুটোকে পাঠিয়েছে নয়ত কি হতে যে কি হত সে খবর কে জানে। মেলা থেকে ফেরার পথে বৃষ্টির বাগড়ায় এখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম দুজন। মেলায় আমার যাবার ইচ্ছে, পরিকল্পনা কোনটায় ছিল না। চৈতির হুটহাট পাগলামিতে মাঝে মাঝে এমন করে যেখানে সেখানে যেতে হয় আর এতে মুটামুটি অভ্যস্ত আমি। আলতার গুড়ো ভর্তি একটা প্যাকেট, লাল দু ডজন চুড়ি, এক পাতা কালো টিপ আর কিছু বাতাসা কিনে দিয়েছি তাকে। এতেই সে বেজায় খুশী, ফেরার পথে বাতাসার ঠোঙাটা আমার কাছে দিয়ে তার

সজ্জা সামগ্রীর জিনিস সমূহ খুব যত্নে বুকের সাথে জাপটে ধরে রেখেছিল ঠিক যেমনটা করতাম ছোটবেলায় স্কুলের যাবার সময় বইগুলো বুকে জাপটে ধরে।সাঁকো পার হবার সময় এক হাত দিয়ে সেগুলো জাপটে ধরে রেখেছিল অথচ একটু হেরফের হলেই খালের পচা কালো পানিতে পরনের হলদে শাড়িটা কালো হয়ে তাকে কালো ভুতনী বানিয়ে দিত সে ব্যাপারে তার কোন মাথা ব্যথা ছিল না। হঠাৎ করেই ঝুম বৃষ্টি নামাতে এই পোড়াবাড়িতে উঠতে হয়েছে। যাক বৃষ্টি একটু থেমেছে, দ্রুত পা বাড়াতে লাগলাম যদি চৈতিকে ধরে ফেলতে পারি এই আশায় কিন্তু ততক্ষনে সে বাড়ি চলে গেছে। চৈতির আর আমাদের বাড়ি পাশাপাশি, ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছি, খেলেছি, এখনো বাড়ির উঠানে ওদের সাথে লুডু খেলি পাটি বিছিয়ে। চৈতি এবার মাধ্যমিক দেবে আর আমি উচ্চ মাধ্যমিক । আমার কলেজ ওর স্কুলের সাথে হওয়ায় রোজ একসাথেই কলেজ যায়, আবার ফেরার সময়ও একসাথেই ফিরি। মাঝে মাঝে এমন হয় আমি ওর জন্য তিন ঘন্টাও অপেক্ষা করি আবার ও আমার জন্যও অনেক সময় অপেক্ষা করে

উদ্দেশ্য একসাথে বাড়ি ফেরা। চৈতি মাধ্যমিকে পড়লেও ওর বয়স সতের ছুঁই ছুঁই আর আমার উনিশ।আমাদের দু পরিবারের মাঝে অনেক সখত্যা রয়েছে, চৈতির বাড়ির সবাই আমাকে অনেক স্নেহ করে, ভালমন্দ রান্না করলে জেঠিমা আমাকে তরকারি না দিয়ে বা না ডেকে খান না, জেঠাও তেমন বাজারে দেখলে ডাক দিয়ে পেট পুরে মিষ্টি খাইয়ে ছাড়ে। শুধু ওর বুড়ো ঠাকুমাটাই যত ঝামেলা পাকায়, আমাকে দেখলেই চৈতিকে আমার সামনে আসতে দেন না আর চৈতি চলে আসলেও নানা অজুহাতে আমার সামনে থাকতে দেন না তিনি,জানিনা কবে তার কি ক্ষতি করেছিলাম আমি। না, আজ আর বুড়িটা নেই, চৈতি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের ধুলো উড়ে যাওয়া দৃশ্যটা দেখতে ব্যস্ত আমি চুপি চুপি পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম, তার খোলা চুলের ঘ্রান নিলাম এক নিশ্বাসে, চৈতি পিছনে না ফিরেই বলল-হয়েছে ঘ্রান নেয়া? নেয়া হলে যাওতো, মা চলে আসবে এক্ষুনি। আমি খানিকটা ভড়কে গেলাম কেননা চৈতির জানার কথা ছিল না যে আমি তার পিছনে, একেই বলে প্রখর অনুভুতির শক্তি। জেঠীমার পায়ের আওয়াজে বেরিয়ে

আসলাম। চৈতিকে কখনো বলিনি ভালবাসি, কাউকে ভালবাসি এটা ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলার চেয়ে তাকে যে আমি ভালবাসি সেটা বুঝিয়ে দিতে পারাটাই ভালবাসা, অনুভুতি হালকা হয়ে আসে প্রকাশে। কোন এক দুপুরে যখন দিঘীতে দুজন লাল পদ্ম তুলছিলাম তখন আকস্মিকভাবে চৈতির পা কেটে গিয়েছিল ভাঙা কাচের টুকরোয়, দিঘীর ঘাটলায় ওকে বসিয়ে পা টা আমার কোলের মাঝে এনে দেখি গলগলিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ছে, রক্ত দেখেই চৈতি কান্না শুরু করল। দৌড়ে গিয়ে দুবলা ঘাস নিয়ে এসে তা চিবিয়ে ওর পায়ে লাগিয়ে দিয়েছিলাম তখনো চৈতি কেঁদেই চলেছিল। চৈতির কান্না দেখে আমারো কান্না চলে আসল, টুপটাপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছিল আমার চোখ দিয়ে। এক পর্যায়ে চৈতির কাটা জায়গায় আমার ঠোট ছুঁইয়ে চুমু খেয়েছিলাম, দ্রুত ছুটে আসা গাড়ি যেমন হঠাৎ ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ে চৈতিও তেমন হুট করে কান্না থামিয়ে ফ্যাল ফ্যাল চোখে আমার দিকে তাকালো। আমার চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে না পেরে জাপ্টে ধরে আবার কেঁদে দিয়েছিল, সেখান থেকেই একটা অলিখিত এক নতুন

সম্পর্কে দুটো প্রান। যে প্রান এক সাথে কৈশরের দুরন্তপনার সাক্ষী, একসাথে বয়:সন্ধি পেরোনোর সাক্ষী…এক সাথে নতুন যৌবনে পা রাখার সাক্ষী। সন্ধ্যায় খুব একা একা লাগছিল, পড়ায় মনও বসছিল না, চৈতির ঘরের জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। অনেকটা ঝোপের মত একটা জায়গা, চৈতির ফেলে দেয়া বাতাসার লাল ঠোঙাটা পড়ে আছে তাতে কয়েকশ পিঁপড়া লাইন দিয়েছে, পিঁপড়ারর জাত বড়ই অদ্ভুত একজন চললে আরেকজন তার পিছু নেয় যতটা না খাবারের গন্ধে তার চেয়ে বেশি পিছু নেয়া স্বভাবে, আমিও তার বাইরে নয়। চৈতির পিছনে লেগে আছি এই লাল পিঁপড়াদের মত তফাত একটা জায়গায় ওরা লাল আর আমি কালো। চৈতি ল্যাম্পের আলোতে বইয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কোন আওয়াজ করছেনা। ফিসফিস করে বেশ কয়েকবার ডাকার পর চৈতি দরজা বন্ধ করে ল্যাম্পটা নিয়ে জানালার পাশে আসল, জানালার একটা রড ভাঙা থাকার কারনে অতি সহজেই সেখান দিয়ে একটা আস্ত মানুষ ঢোকা সম্ভব। চৈতির খোলা চুল আর জাম রঙের জামাতে ল্যাম্পের আলোয় চৈতিকে বেশ সুন্দর লাগছে। চৈতি কুজো হয়ে ল্যাম্পটা দুজনের মাঝে রাখল, দুজন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি দুজনার দিকে কেউ কোন কথা বলছিনা।

চোখের সামনে এমন একটা সুন্দরী দাঁড়িয়ে থাকলে কোন মহাপুরুষের মুখ দিয়েও একটা শব্দ বের হবেনা, কে চায় কথা বলে এমন সুন্দর মুহুর্ত নস্ট করতে। চৈতির নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে, ল্যাম্পটা ফু দিয়ে নিভিয়ে দিলাম। পূর্ন জ্যোৎস্নাতে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে চৈতির মুখখানা, নাকের উপর জমতে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামকে এই মুহুর্তে ইশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য বলে মনে হচ্ছে। আলতো করে চৈতির নাকের ডগায় কামড় বসিয়ে দিলাম। কামড়টা এতটাই জোরে দিয়ে ফেলেছিলাম যে চৈতি চিৎকার দিয়ে মাগো বলে ডেকে উঠেছিল। পরিস্থিতি ভাল না দেখে আমি পালিয়েছিলাম সেখান থেকে। এভাবেই নানা খুনসুটি, ঝগড়া, এক সাথে দিঘীতে সাঁতরে বেড়ানো, কলেজ ফেরা চলছিল। আমার উচ্চমাধ্যমিক শেষে আমি চলে আসলাম কলকাতায়। আসার সময় চৈতি তার একটা ওড়না দিয়ে দিয়েছিল সাথে করে, তার একটা ডায়েরি, তার একটা চুল, তার চিকরুনি আর তার একখানা সাদাকালো ছবি। কলকাতায় এসে প্রথম প্রথম খুব কস্টে কাটতো আমার দিন,সারা রাতদিন চৈতির কথা ভেবেই কাটাতাম।একটা সময়ে

সয়ে নিলাম সব কিন্তু মন থেকে সদ্য সতেরো বছরে পা দেয়া চৈতিকে কোনমতে মুছতে পারিনি আর সেটা আমি কোনদিনও চাইনি। ক্লাসে যাবার আগে বা বাইরে বের হবার আগে চৈতির চিরুনি দিয়ে মাথা আচড়ে যেতাম,তার ওড়না দিয়ে মুখ মুছতাম আর বুক পকেটে তার ঐ দেড় হাত সমান চুল আর সাদাকালো ছবিটা সারাক্ষণ ই থাকত। চিঠি পাঠাবার কোন উপায় ছিল না কেননা চৈতির বাবা ই পোস্টঅফিস এর হেড আর টেলিফোন আমাদের ওদিকে এখনো পৌছাইনি। বাড়ি থেকে আসতে যেতে অনেক টাকা খরচ হওয়াতে ঘনঘন বা দু তিন মাসে একবারও যাওয়া কষ্টসাধ্য ছিল আমার পক্ষে। ছয় মাস একুশ দিনের মাথায় বাড়ি গেলাম। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! বাবা আমাকে দেখেই হাটে চলে গেলেন বড় মাছ

কিনতে। চৈতির বাবা, মা সবাই আসল আমাকে দেখতে কিন্তু আমি তো খুজিছিলাম আমার চৈতিকে। দেখতে কেমন হয়েছে এখন ভগবান ই জানে। ও আমার কাছে লজ্জাতে আসছেনা। আমি কাপড় বদলেই ওদের বাড়ি চলে গেলাম। ওর বুড়ো ঠাকুমা আমাকে দেখে এবার আর কপাল কুচকালেন না অনেকদিন পর এসেছি তাই হয়ত। চৈতির ঘরে ঢুকে গেলাম কিন্তু চৈতি নেই। কাউকে কিছু বলতেও পারছিনা, দিঘীর ঘাটে গেলাম কিন্তু সেখানেও নেই চৈতি। বাড়ি ফিরে আবার ওদের বাড়ি গেলাম, জেঠিমাকে বললাম- চৈতি কি কলেজে গেছে? , জেঠিমা হেসে বলল- এ মা! দেখেছিস তোকে বলতেই ভুলে গেছি, চৈতির বিয়ে হল গত মাসের তের তারিখে। ওর বর বিশাল বড় উকিল। পরশু ওরা আসবে, তোর জেঠার কাছে চিঠি

পাঠিয়েছিল। আমার ধমনী থমকে গেল, আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসল। ঘরে এসে কবাট লাগিয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম, অনেক কেঁদেছিলাম। মাকে জড়িয়ে সারাটা রাত কেঁদেছিলাম, মা সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেল যে। ভোরবেলায় কাউকে কিছু না বলে কলকাতায় চলে আসলাম। কেননা আগামীকালের দৃশ্য দেখার সাহস ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই। ভালবাসার মানুষটা অন্যর বুকে যখন নিজেকে হারিয়ে খুঁজবে আর সেই দৃশ্যটা যখন আমাকেই দেখতে হবে তখন আমি স্বাভাবিক থাকতে পারব তো? এই একটা প্রশ্ন আমাকে আজ অনেক দূরে এনে দাড় করিয়েছে কেননা :-

ভালবাসার লাল দাগে বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায়, কলমে কাপুনী ধরে যায়, গোল চাঁদটাও ফিকে হয়ে যায়।

Leave a Reply