নারীদের মৃতদেহ নিয়ে-
নারীর লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরিতে নারী কনস্টেবল কিংবা কোনো স্বজনকে দিয়েই মৃতদেহ ওলটপালট করানোর নিয়ম। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ নিয়ম মানা হচ্ছে না।
থানা পুলিশের কর্মকর্তারা এ হাসপাতাল মর্গে নারীর লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করছেন পুরুষ দিয়েই। কখনও স্পেশাল বয়, কখনও রোগীর দালাল আবার কখনও অ্যাম্বুলেন্সের দালালকে দিয়ে নারীর লাশ ওলটপালট করিয়ে তারা সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন।
শুধু তাই নয়,
নারী মৃতদেহের স্পর্শকাতর স্থানগুলোও পরীক্ষা করা হয় তাদের দিয়েই। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা সম্পূর্ণরূপে শালীনতা, নৈতিকতা ও ইসলামী শরিয়ত পরিপন্থী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শালীনতা পরিপন্থী কাজ অবাধে করলেও তা পুলিশ কর্মকর্তারা আড়ালেই রাখছেন। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষ দিয়ে লাশ ওলটপালট করানোর বিষয়টি সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন না।
আবার কোনো কোনো কর্মকর্তা সুরতহাল প্রতিবেদনে পুরুষ দিয়ে নারীর মৃতদেহ ওলটপালট করানোর বিষয়টি নির্দ্বিধায় উল্লেখ করে থাকেন।
গত ৩ সেপ্টেম্বর হোটেল বয়ের উত্ত্যক্তের কারণে অভিমান করে কীটনাশকপানে আত্মহত্যা করেন ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার বড়ভাঙ্গা এলাকার কাজী এমদাদুল হকের বাড়ির ভাড়াটিয়া লাকী বেগম (২৭)। তিনি সিঙ্গাপুর প্রবাসী আবদুস সালামের স্ত্রী।
ওইদিন রাত ৯টা ৪০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে তার মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করতে আসেন ডেমরা থানার এসআই তহিদুল ইসলাম। এ সময় তার সঙ্গে কোনো নারী পুলিশ কনস্টেবলও ছিলেন না।
তিনি সহযোগিতার জন্য ডাকেন অ্যাম্বুলেন্সের দালাল পাপ্পুকে। তাকে দিয়ে লাকী বেগমের মৃতদেহটি ওলটপালট করিয়ে তৈরি করেন সুরতহাল প্রতিবেদন। সুরতহাল প্রতিবেদনের একটি কপি এসেছে সংবাদমাধ্যমের হাতে।
এতে তিনি দালাল পাপ্পুকে সরকারি মর্গ রক্ষণাবেক্ষণকারী উল্লেখ করে বলেন,
পাপ্পুর সহযোগিতায় তিনি লাকী বেগমের মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে তিনি পাপ্পুকে দিয়ে লাকী বেগমের মৃতদেহটি ওলটপালট করার সব বর্ণনা দিয়েছেন।
প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, ‘মৃত লাকী বেগমের পরনে থাকা গোলাপি রঙের থ্রিপিসের জামা ও গোলাপি রঙের পাজামা পাপ্পুর মাধ্যমে সরিয়ে মলদ্বার এবং যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করাইলাম।’
এভাবে প্রতিবেদন তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে ডেমরা থানার এসআই তহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পাপ্পুকে দিয়ে লাকী বেগমের জামাকাপড়ের বোতাম খোলানো হয়েছে।
বডি ওলটপালট করানো হয়েছে।’ মলদ্বার ও গোপনাঙ্গ পরীক্ষার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তা এড়ানোর চেষ্টা করেন এসআই তহিদুল ইসলাম।
তিনি দাবি করেন, ‘
লাকী বেগমের মা সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির সময় তাদের সহযোগিতা করেছেন।’ জানতে চাইলে অ্যাম্বুলেন্সের দালাল পাপ্পুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘দারোগার সঙ্গে কোনো মহিলা ছিল না।
আমাকে দিয়েই তিনি লাকী বেগমের জামাকাপড় খুলিয়ে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন।এর আগে ১৮ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ৩৫ বছর বয়সী এক নারীর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন যাত্রাবাড়ী থানার এসআই সাহিদ।
ওই নারী চিটাগাং রোডে পিকআপভ্যানের ধাক্কায় আহত হয়ে ঢামেক হাসপাতালে মারা যান। তার মৃতদেহ ওলটপালট করানো এবং জামাকাপড় খুলে স্পর্শকাতর স্থান পরীক্ষা করানো হয় স্পেশাল বয় জাহাঙ্গীরকে দিয়ে।
জাহাঙ্গীর জানান, তাকে দিয়েই মৃতদেহের সুরতহালের সব কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। সেখানে কোনো নারী কিংবা নারী পুলিশ ছিল না।
জাহাঙ্গীর আরও জানান, বেশিরভাগ সময় পুলিশ তাদের দিয়েই লাশ ওলটপালট করিয়ে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে। শরীরের স্পর্শকাতর স্থান দেখে তা পুলিশের কাছে বর্ণনা করতে হয় তাদের।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এসআই সাহিদ বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘শালীনতা রক্ষা করেই ওই নারীর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।’
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘
খুন, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা বা অন্য কোনোভাবে কারও অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে ফৌজদারি আইন অনুসারে ময়নাতদন্তের আগে মৃতদেহ কী অবস্থায় পাওয়া গেছে অর্থাৎ শরীরে ক্ষত, আঘাতের চিহ্ন, ভাঙা, মচকানো বা আঁচড়ের দাগ এবং কী ধরনের অস্ত্র বা যন্ত্রের (যদি থাকে) মাধ্যমে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে কিনা তা উল্লেখ করে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়।
আইন অনুযায়ী সুরতহাল প্রতিবেদনে লাশের পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিভিন্ন দিকের বর্ণনা থাকতে হয়। শরীরের কোন অঙ্গটি কীভাবে পাওয়া গেছে, কোনো আঘাত বা দাগের চিহ্ন আছে কিনা প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। আর শালীনতার সঙ্গে এসব কাজ সম্পন্ন করতে হয়।’
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় রাজধানীর কয়েকটি থানার ওসির সঙ্গে। পল্লবী থানার ওসি দাদন ফকির বলেন, ‘শালীনতা রক্ষা করেই নারীর লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করার নিয়ম।
সেক্ষেত্রে নারী কনস্টেবল কিংবা কোনো নারী স্বজনকে দিয়ে লাশ ওলটপালট করাতে হয়। কোনো পুরুষ দিয়ে নারীর মৃতদেহ ওলটপালট করানো সম্পূর্ণরূপে নৈতিকতা পরিপন্থী কাজ।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ড. জয়নব মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘পুরুষ দিয়ে নারীর মৃতদেহ ওলটপালট করানো এবং লজ্জাস্থান পর্যবেক্ষণ করানো শালীনতা এবং ইসলামী শরিয়ত পরিপন্থী কাজ।
একজন মানুষকে জীবিত থাকাকালে যেমন সম্মান দেয়া হয়, মারা গেলেও তার মৃতদেহকে তেমনই সম্মান দিতে হয়।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, নারীর লাশের সুরতহাল পুরুষকে দিয়ে করানো শুধু শালীনতা পরিপন্থীই নয়, নৈতিকতা পরিপন্থীও।
তিনি বলেন, পুলিশ নারীর মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরিতে নানা অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের জেন্ডার বিষয়ক ধারণা নেই, নেই কোন ট্রেনিংও। এ কারণে এরা নিয়মবহির্ভূতভাবে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে।