Sunday, April 21

করোনাভাইরাস: এক অদৃশ্য খুনির পৃথিবী ভ্রমণ

Corona Virus, Dhaka, Bangladesh

সম্প্রতি চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন এক রোগের জীবাণু নভেল করোনাভাইরাস। এই ভাইরাসের প্রভাব পৃথিবীতে এমনভাবেই ছড়িয়ে পড়েছে যে স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা পৃথিবী জুড়ে স্বাস্থ্যখাতে জরুরি অবস্থা জারি করেছে।

করোনাভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন করোনা শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। যার অর্থ মুকুট, কারণ বৈদ্যুতিক অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসটি দেখতে অনেকটা মুকুটের মতোই। ১৯৬০ এর দশকে মুরগির সংক্রামক ভাইরাস হিসেবে প্রথম করোনাভাইরাস নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। পরবর্তীতে যখন মানুষের দেহে এ ভাইরাস সংক্রমিত হয় তখন তা কেবল সাধারণ সর্দি-কাশিতেই এটি পাওয়া যায়।সেসময় মানুষের দেহে দুই ধরনের করোনাভাইরাসই পাওয়া যেতো। মানুষের মধ্যে পাওয়া সেই ভাইরাস দুটি হিউম্যান করোনাভাইরাস ২২৯-ই এবং হিউম্যান করোনাভাইরাস ওসি৪৩ (OC43) নামে নামকরণ করা হয়।এরপর ২০০৩, ২০০৪,  ২০০৫ ও ২০১২  সালে এই ভাইরাসটির আরও বেশ কিছু প্রজাতি দেখা যায়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের শেষের দিকে চীনে করোনাভাইরাসের একটি নতুন জাত আবিষ্কৃত হয়। ভাইরাসের এই প্রজাতিটি এতটাই নতুন যে এটির নতুন কোনো নামকরণ করা হয়নি। তাই একে বলা হয় নভেল করোনাভাইরাস। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যেই করোনাভাইরাস পরিবারের এই নতুন সদস্যের নামকরণ করেছে “2019 nCov” নামে। নভেল করোনাভাইরাস সহ এখনো পর্যন্ত প্রায় সাত প্রকারের ভাইরাস শনাক্ত করা গেছে যা মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। 
২০০২ সালে SARS এবং 2012 সালের MERS নামে যে দুটি মারাত্মক ভাইরাস চীনে মহামারীর সৃষ্টি করেছিলো সে দুটিও ছিল এক ধরনের করোনাভাইরাস।২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের এই নতুন প্রজাতির সংক্রমণ দেখা দেয়। চলতি বছর ১৬ মার্চ পর্যন্ত মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ১৫০ অধিক দেশ ও অঞ্চলে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। এ দেশগুতে মোট লক্ষাধিক লোক এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। মৃত্যুবরণ করা অর্ধেকই চীনের নাগরিক এবং এর বাইরে ইউরোপে এর বিস্তারের গতি দেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই মহাদেশকে বর্তমানে করোনাভাইরাস ছড়ানোর কেন্দ্রবিন্দু বলে উল্লেখ করেছে।  সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্স। এরইমধ্যে ইতালিতে একদিনে সর্বোচ্চ ৩৬৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছে যে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের একটি সামুদ্রিক খাবারের বাজার থেকে সাপের মাধ্যমে এই ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে। উহানের ওই বাজারে কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর, বাদুড়, সাপসহ নানা রকমের বন্যপ্রাণী খাবার হিসেবে বিক্রি করা হয়। প্রথমদিকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের অনেকেই ঐ বাজারে গিয়েছিল বলে, চিকিৎসকেরা ধারণা করেছেন ভাইরাসটি ওখান থেকেই ছড়াতে পারে। তবে ইসরাইলের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তার দাবি চীনের একটি জীবাণু অস্ত্রের কারখানা থেকে নতুন কোন এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাস নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে চীনের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির গবেষণাগারটি হচ্ছে উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি। চীনা কতৃপক্ষ আগেই স্বীকার করেছিল যে উহানের এই গবেষণাগারটিতে তারা মারাত্মক প্রাণঘাতি ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করে। আর এখন এই উহান শহর থেকেই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে।করোনা ভাইরাসের লক্ষণ গুলো অনেকটা নিউমোনিয়ার মতো। এই ভাইরাস মূলত শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ঘটায়। রোগের লক্ষণ শুরু হয় জ্বর দিয়ে, সেইসাথে সর্দি বা শুকনো কাশি মাথাব্যথা গলাব্যথা ওর শরীর ব্যথা সহ শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। চীনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন মানুষের দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর ১ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে এর লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তবে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগেও তার কাছ থেকে এই রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে। সাধারণ ফ্লুঁর মতোই হাঁচি-কাশির মাধ্যমে নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। একেবারেই নতুন আবিষ্কৃত হওয়া এই ভাইরাসটি প্রতিহত করার কোন নির্দিষ্ট ঔষধ বা চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হলে কিছুদিন পর সাধারণ সর্দি-কাশির মত এমনিতেই এই রোগ সেরে যেতে পারে। ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্র, ফুসফুস এর পুরনো রোগীদের ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এত শঙ্কার মাঝেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে এ রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের সরকার এ ভাইরাস রোধে বিভিন্ন সতর্কতা জারি করছে। জনগনকে সমাবেশ ও জনবসতিপূর্ণ এলাকায় না যাওয়ার কড়া নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করছে। বিমানে যাত্রী আসা যাওয়ার সময় একাধিক স্তরে তাপমাত্রা চেক করা হচ্ছে ও বিদেশ থেকে কেও আসলে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। সরকারের এই নির্দেশনাগুলো যদি দেশের দায়িত্বশীল নাগরিকগণ সচেতনতার সাথে পালন করেন তবে অবশ্যই এক পর্যায়ে পৃথিবী থেকে এই রোগ বিলীন করা যাবে। তবেই আবারো আমরা ফিরে পাবো এক স্বাভাবিক সুস্থ পৃথিবী।

Leave a Reply