Saturday, April 13

আমার মিটিং হলে ঢুকতে দিতাম না : তারেক রহমান

২০০৬। এই মুহূর্তে মাসটি মনে পড়ছে না। পড়ন্ত বিকাল। আমি তখন প্রথম আলোর ডেপুটি চিফ রিপোর্টার। প্রিয় সম্পাদক মতিউর রহমান তাঁর রুমে ডেকে পাঠালেন। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলাম। টুকটাক বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞেস করলেন। চলমান রাজনীতি, প্রশাসন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হলো। মতি ভাই নিজের জন্য চায়ের অর্ডার দিলেন। আমার জন্যেও। এরপর একটা খাম হাতে দিলেন। জিজ্ঞেস করি, এটা কী? সম্পাদক বলেন, খোল। দেখো কি আছে। খুললাম। উকিল নোটিশ। তারেক রহমান পাঠিয়েছেন। তখন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব। সম্পাদক, প্রকাশক আর আমাকে।

কেন? উকিল নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘তারেক রহমানের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে’ শিরোনামে প্রথম আলোতে আরিফুর রহমান যে প্রতিবেদন লিখেছেন তাতে তারেক রহমানের সম্মানহানি হয়েছে। শত কোটি টাকার মানহানি হয়েছে। রিপোর্টটি মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে কেন শত কোটি টাকার মানহানি মামলা হবে না তা জানতে চেয়েছেন তারেক রহমানের আইনজীবী। মতি ভাই বললেন, বলো কী করা যায়? আমি বললাম মতি ভাই রিপোর্টতো ঠিকই আছে। আমাদের জবাব দিতে হবে উকিল নোটিশের। মামলা হলে দেখা যাবে। মতি ভাই বললেন, ঠিকই বলেছো। এক কাজ করো, আমি ড. কামাল হোসেনকে বলে দিচ্ছি। তুমি দেখা করো। জবাব তৈরি করো তোমরা মিলে। পাঠিয়ে দাও। বাকি সব পরে দেখা যাবে।

প্রথম আলো সম্পাদকের নির্দেশনা পেয়ে কথা বললাম দেশসেরা আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে। মতিঝিলে তাঁর চেম্বারে। অসম্ভব ব্যস্ত আইনজীবী। প্রথমবার বললেন, ‘মতিউর রহমানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আপনি তাজবীবের (ব্যারিস্টার তানজীব-উল-আলম) সঙ্গে বসেন। আপনারা একটা খসড়া তৈরি করেন। ফাইনালি আমি দেখবো’।

দুই দিন লাগলো এই জবাব তৈরিতে। প্রথমে আমি একটা দাঁড় করালাম। এর ওপর ঘষামাজা করলেন ব্যারিস্টার তানজীব-উল-আলম। আর চূড়ান্তটি ড. কামাল হোসেন। মতি ভাইও একবার দেখলেন। এরপর পাঠিয়ে দেওয়া হলো তারেক রহমানের আইনজীবীর কাছে।
এই জবাবের পরে আর এগোননি তারেক রহমান বা তাঁর আইনজীবী। কিন্তু পরে ঠিকই ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন তারেক রহমান। কীভাবে? সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

যে রিপোর্টে ক্ষুব্ধ হয়ে তারেক রহমান উকিল নোটিশ পাঠান তার শিরোনাম আগেই বলেছি। ‘বিএনপিতে তারেকের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে’। বিষয়টি বিএনপিতে এক প্রকার ‘ওপেন সিক্রেট’ই ছিল। বিএনপির বাইরেও এ নিয়ে আলোচনা ছিল বিভিন্ন মহলে। কিন্তু লিখতে সাহস করছিল না কেউ। সেই কাজটি করে প্রথম আলো এবং আমি। প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন সিনিয়র নেতাদের অনেকেই তারেক রহমানের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত ছিলেন। তরুণ কিছু নেতা নিয়ে তারেক রহমান একটি বলয় গড়ে তুলেছেন সরকার ও দলে। তাঁদের দাপটই সব জায়গায় দৃশ্যমান। নিজেদের মধ্যে আলোচনায় তারা বিষয়টি তুলে আনতেন। এর প্রতিকার নিয়ে কথা বলতেন। কিন্তু কুলকিনারাও করতে পারছিলেন না তাঁরা। প্রথম আলোর প্রথম পাতায় লিড স্টোরি হয়েছিল বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের এই খবর।

বছরের পর বছর বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক হয়না। গঠনতন্ত্র মানছে না দলটি। এমন প্রতিবেদনও প্রথম আলোতে কয়েকবার হয়েছে, করেছি। অবশেষে বিএনপি তাদের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকলো। গণভবনে ডাকা হলো এই বৈঠক। প্রথম আলো থেকে আমাকেই কাভার করার দায়িত্ব দেওয়া হলো। যথারীতি গেলাম। বিকাল বেলা। গণভবনে বিরাট প্যান্ডেল করা হয়েছে, দলটির নির্বাহী কমিটির নেতারাও যথারীতি এসেছেন, গণমাধ্যম কর্মীরাও আছেন। ভাবলাম অনেকক্ষণ থাকতে হয় কি না, একটু শৌচাগার ঘুরে আসাই ভালো। পা বাড়ালাম সেদিকে। কয়েক পা আগাতেই দেখি তারেক রহমান এগিয়ে আসছেন, সঙ্গে লুৎফুজাম্মান বাবর, হারিছ চৌধুরীসহ জনা দশেক তরুণ প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সাংসদ। আমাকে দেখতেই তারেক বলে উঠলেন, ‘এটি বিএনপি নির্বাহী কমিটির বৈঠক। তাই ঢুকতে পেরেছেন। আমার মিটিং হলে ঢুকতে দিতাম না’। চুপ থাকা কি ঠিক হবে? মুহুর্তেই নিজেকে প্রশ্ন করি? এরপর বলি, আমি একজন সংবাদকর্মী। আমাকে নিয়ে যে ভাবেন, এজন্য ধন্যবাদ। তারেক রহমানের সঙ্গীরা বোধহয় আশা করেননি, আমি ওইভাবে জবাব দেব। সবাই চুপচাপ। কেউই কথা বাড়ালেন না, এগিয়ে চললেন সামনের দিকে।

আমিও আমার গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালাম। আমার লেখনী যে অনেককেই অখুশি করে, করছে এটা বুঝি। বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হয়না। ভালোও লাগে। ক্ষমতাসীনরা এইভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়! দারুণ তো!! রাখে আল্লাহ, মারে কে?

আরিফুর রহমান: সম্পাদক, ঢাকাটাইমস ও এই সময়

Leave a Reply